আমার প্রথম প্রেমিকা ইছামতি। তার বুকের উপর আমার বসবাস। আমার ঘরের উঠোন জুড়ে আছে সে। আমার প্রাণের উপকূল জুড়ে তার প্রবাহমানতা। তার কোল ছেড়ে আমি বেশি দিন অন্য কোথাও গিয়ে থাকতে পারি না। সে আমার বাল্যকালের সখা; যৌবনের প্রেয়সী। আমি যতই বলবো তার কথা ততই কম বলা হবে।
আমার গ্রামের নাম বাজিতপুর। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র নায়িকা কুসুমের বাপের বাড়ি ছিল বাজিতপুর। কিন্তু সেই গ্রাম আর আমার গ্রাম এক না হলেও এ গ্রামের পথে আমি কুসুমকে খুঁজে পাই। সে আজো শশী দাদাবাবুর উদাসীন প্রেমে আকুল হয়ে কেঁদে চলে সারারাত। আমার ছোটবেলার বেশিরভাগটাই কেটেছে নদীহীন মামার বাড়ির দেশে। যখনই নিজের গ্রামে যাবার সুযোগ পেয়েছি, নানা ছলে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতাম নদীর পাড়ে। সে সময় আমাদের নদীর ঘাটের কাছে অনেক কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, অর্জুন আর গাম্বুল গাছ ছিল। ঋতুতে ঋতুতে সে সব গাছে বিচিত্র ফুল ধরত। কি অপূর্ব তার শোভা। কিন্তু দুহাজার সালে উত্তর চব্বিশ পরগণার প্রবল বন্যায় উত্তাল হল নদী। পাড় ভেঙে ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মত ইছামতি ভাসিয়ে নিয়ে গেল সেই সব প্রস্ফুটিত গাছগুলোকে। ভেঙে গেল নদী পারের কাঁচা রাস্তা। তারপর কুড়ি বছর কেটে গেছে।
এখন নদীর বাঁধানো পাড়ে অসংখ্য কিশোর গাছপালা। কিন্তু ছেলেবেলার সেই শোভা আর দেখতে পাই না। বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে অনাবিল বিস্ময়য়ের সেই চোখও অন্ধ হয়ে গেছে। ‘পথের পাঁচালী’ অপুর মতই ছিল আমার ছেলেবেলাটা। বাড়ি এলেই সারাদিন আমবাগান, মাঠঘাট আর সবচেয়ে বেশি নদীর পাড়েই সময় কেটে যেত। আমাদের এক দাদু ছিল। আগে ইন্ডিয়ান আর্মিতে ছিল। অবসর নেওয়ার পর গ্রামের বাড়ি এসে একটা ডিঙি নৌকা বানিয়েছিল। আমরা ছোটরা মাঝে মাঝেই তার কাছে বায়না ধরতাম, দাদু নদীতে বেড়াতে যাবো। দাদু আমাদের আবদার ফেলত না। দাদু আর ঠাকুমা রোজ দুপুরে নৌকা নিয়ে ঘাস কাটতে যেত নদীর ওপারে। এপারের অনেক বড় বড় গাছপালা থাকলেও ঘাসজমি তেমন ছিল না। ও পারের চরে ছিল বিশাল তৃণভূমি। আমি প্রায়ই দিন ওদের সঙ্গে নৌকা করে চলে যেতাম ও পারে। ঘাসের মধ্যে থেকে দৌড়ে দৌড়ে ঘাসফড়িঙ ধরতাম।
কত দিন ভর দুপুরে বড় বোন আর আমি একটা ‘লগি’ হাতে নিয়ে চলে যেতাম নদীর পারে। জোয়ারের জলে তরমুজ ভেসে আসতো কত। বসিরহাট ডকে তরমুজ ভর্তি নৌকা মাঝে মাঝেই ডুবে যেত। তাছাড়া বেশি তরমুজ বোঝাই করার কারনে ঢেউয়ের দোলায় অনেক তরমুজ নদীতে পড়ে যেত। আমরা বাঁশের সরু লগি দিয়ে নদী থেকে তুলে আনতাম সেই তরমুজ। কি যে আনন্দ হত! বাড়িতে এনে আমরা তিন ভাই-বোন মিলে ভাগ করে খেতাম। বহুদিন ইছামতি থেকে বেরিয়ে আসা খালে নেমে মায়ের সঙ্গে জল হাতড়ে মাছ ধরেছি। গুলে মাছেরা লুকিয়ে থাকতো গর্তে। গর্তের তিনটে করে মুখ থাকতো। আমরা দুটো মুখ দিয়ে আঙুল ঢুকিয়ে দিতাম তার অন্য মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসতো গুলে মাছ।
তাছাড়া নোনা কেটে গেলে খালে অসংখ্য সরপুঁটি, চাঁদা, বেলে ইত্যাদি বহু মাছ মিলত। সারা গায়ে নদীর কাদা মেখে তারপর নদী থেকে স্নান সেরেই ঘরে ফিরতাম। মায়ের সঙ্গে ইছামতির খালে নেমে মাছ ধরার সেই ছেলেবেলা চিরকালের মত হারিয়ে গেছে। তবে সেই সব স্মৃতি মনের ক্যানভাসে আজো অমলিন হয়ে আছে। যত বড় হলাম সেই চেনা নদীটাই সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপে ধরা দিতে লাগলো আমার কাছে। জীবনের সব দুঃখের দিনে বার বার ছুটে গেছি নদীর পারে। হাপুস হৃদয়ে কেঁদেছি তার পারে বসে। হালকা হয়েছি। চাঁদহীন রাতের অন্ধকারেও একা কতবার নদীটার পারে বসে কাটিয়েছি বহুক্ষণ। মনে হয় আমি যেন তার কথা শুনতে পাই; সে শোনে আমার কথা। এক অপার্থিব অনুভব আচ্ছন্ন করে ফেলে আমায়। মনে হয় অনন্ত কাল এই নদীটার পারে বসে বুক ফাটিয়ে শুধু কেঁদে যাই। কান্নার যে কি সুখ এই নদীটা আমায় তা বুঝিয়েছে। আমি কখনো ভাবতেই পারি না এই নদীটার থেকে অনেক দূরে চলে গিয়ে আমি বেঁচে থাকতে পারবো।
কিন্তু আজ সেই নদীটার কাছে গেলে আমার খুব ভয় করে। মনে হয় নদীটা যেন আমাকে অক্টোপাসের মত গিলে ফেলবে। কেন যে এমন হয় আমার বুঝতে পারি না। মাঝে মাঝে খুব অভিমান হয়। ভাবি যাকে এতো ভালোবাসি তাকে এতো ভয় পাই কেন আজ! আসলে এই নদীটা এখন আর আমার নেই। বুঝি নদীটা ক্রমশ অন্য কারো হয়ে যাচ্ছে। ক্রমশ সে গতিপথ পরিবর্তন করে আমার চোখের আড়ালে চলে যেতে চাইছে। নদী তো আসলে নারীর আর এক রূপ। নারী যেমন এক জায়গায় বেশি দিন থেমে থাকতে পারে না, নদীটাও তেমনি। তার শিরায় শিরায় গতি; স্তবিরতার কোনও স্থান নেই। তার গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে না পারলে জীবনও ক্রমশ অথর্ব হয়ে পড়ে। তখন নদী তার পুরনো প্রেমিকের মায়া কাটিয়ে চলে যায় দূরে। অনেক দূরে…
রাজু বিশ্বাস : কবি ও লেখক।