গায়ের মধ্যে সইসষার তেল মাখতে দেখেই বুকের ভেতরটা দাড়াস করে কেঁপে উঠল আকলিমার। শোয়া থেকে লাফিয়ে উঠে ও ফয়জুরের সামনে দাঁড়াল, ‘তোমা যান কই?’
দুই ঠ্যাঙের আঙুলের গলিঘুপ্চি দিয়ে তেল পাচার করে, ফয়জুরের হাত ডান পা ডলতে ডলতে উপরের দিকে উঠে আসছিল। পাছার আগে পিছে মাখা শেষ করে ওর তৈলাক্ত হাত আবার নেমে যাচ্ছিল বাম নিতম্ব হয়ে নিচের দিকে। ওর চোখের সামনেই পায়ের পর্ব শেষ করে এবার হাতের তালুয় তেল মেখে বুকে-পিঠে তেলের ছোপ মারতে লাগল ফয়জুর। আকলিমাকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকতে দেখে তাড়া দিয়ে উঠল, ‘কী দেহো? যাও কাজ করতে যাও!’
আকলিমা কি যেতে পারে! পা যে সরে না ওর। আগে যে তেল মাখার দৃশ্য দেখে মন ভরে যেত, এখন সে দৃশ্য দেখেই ভয় লাগে। অথচ এক সময় কী তারিয়ে তারিয়েই না উপভোগ করত ফয়জুরের এই তেল মাখার দৃশ্যটা! মাঝে মাঝে নিজেও মেখে দিত। বিয়া করতে যাবার সময় পাত্র যেমন সাজ লয়, এই ভাইও তেমনই সাজে নিতিনিত্ত মহানন্দায় যাবার সময়। পত্যেক দিন পান্তা ভাত খেয়ে আর সবুর নাই, সারা গায়ের মধ্যে তেল মাখতে বসে। তেল মাখা যখন শেষ হয়, বিড়ি একখান ফুঁকতে ফুঁকতে কান্ধের মধ্যে গামছা আর টিউবটা নিয়া বাইর হয়ে যায়। আকলিমা যদ্দুর চোখ যায় মানুষটারে চেয়ে চেয়ে দেখে। রণচণ্ডী ছাড়িয়ে যখন সবুজ গাছপালার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যায়, তখনই ফিরে আসে ঘরে। কিন্তু আজকাল ওকে তেল মাখতে দেখলেই মনে হয় মানুষটা যেন সাজে যাইতেছে। আর ফিরবে না। লাশ হয়ে ভাসতে থাকবে মহানন্দার পানিতে। ফয়জুরের তেল চপচপে দুই হাতের পাতা তখন হাতের বাঁকে বাঁকে, ডানায়, বুকে, পিঠে থপ থপ করে তেল ছুঁয়ে দিচ্ছিল। ও ফয়জুরের পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে জেদ করে বসল, ‘মহানন্দায় কিন্তুক যাবেন না!’
ঠাণ্ডা মাথায় গলার চিপাচুপায় তেল পৌঁছে দিতে দিতে ফয়জুর বলল, ‘মহানন্দারে মোর চেয়ে তুই বেশি চিনো। সাতাশ বছর ধরে অর সাথে সংসার করি! তোমা তো সেইদিনের মেয়ে!’
‘সতিন দেখেই তো ভয় পাই। মহানন্দার পানি এখন বিষ! নামলেই মরণ। তোমা যাবেন না।’ কসরৎ করে তখন পিঠের পেছনে তেল পৌঁছে দিচ্ছে ফয়জুর। ‘মহানন্দায় না যাইলে মোর গাটা যে ঠাণ্ডা হয় না আকলি।’
‘তোমা ঘরে আসো, ঠাণ্ডা করে দেই।’
আকলিমা ওর দুধজোড়া উদাম করে দেয়। সেদিকে তাকিয়ে শরীরটা সত্যিই রসে হঠাৎ চাগা দিয়ে উঠল। আকলি সত্যিই সুন্দর! শ্যামলা গায়ে যেন হলুদ মাখানো। চোখ আর ফেরাতে পারে না। তবু ছোটে না ওর মহানন্দার খেয়াল, সাতাশ বছর ধরে ওর বুকে সাঁতরায়, ওর কোলে ডুব দেয়…অরে ছাড়া কি ভালো লাগে? আকলিমাও ওকে টানছে। জোরেশোরে টানছে। টানতে টানতে নিয়ে গেল ঘরে। সকালের রোদ তখন সবে চমক দিয়ে উঠেছে, ও কাঠের দরোজাটা বন্ধ করে দিল!
দুই.
পরদিন সাত-সকালে ঘুম থেকে উঠেই আবার ফয়জুরকে তেল মাখতে দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে উঠল আকলিমার। ‘তোমা দিন দিন পাইছেনটা কী?’
‘আইজ আমারে বাঁধা দিস না আকলি। ঘরের মধ্যে এক ছটাক চাইল নাই। মহানন্দা মোরে ডাকতেছে! মোরে থামাইছ না।’
‘বদরুলের রক্ত এখনো মহানন্দা থেকে মোছে নাই।’
‘মহানন্দায় কি রক্তের দাগ থাকে রে! একদিন গুলি হয়েছে দেখে পত্যেক দিনেই হবে!’
‘পত্যেক দিনই তো বন্দুক নিয়ে বসে থাকে দেখিস না! কোন বেডাটা নামে মহানন্দায়? চাইল নাই ঘরে বসে আছেন কেন? চা বাগানে গেলেই পারেন।’
‘চা-বাগানে মোর পোষায় না।’
‘না পোষালেও যেতে হবে। মানুষে যেতেছে না। এইটার নাম সংসার! মহানন্দায় গিয়ে মরতে চান? যান মরেন!’
‘মহানন্দায় মোরে একটা পিপড়াও কোনোদিন কামড়ায় নাই। তুই ভয় পাইস না। মোর কিছুই হবে না।’
‘না হোক কিছু। তোমা ঘরে বসে থাকো। দরকার হয়, না খেয়ে থাকব।’
তেল দেয়ার ইচ্ছেটা আর থাকে না ফযজুরের। মন মরে যায়। ও দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে থাকে। আজ প্রায় দুই মাস হলো মহানন্দায় যাওয়া হয় না। শুধু ওর কেনো? তেঁতুলিয়া থানার সমস্ত লোকের। নামা নিষেধ। বিডিআর তো পারের দিকে ভিড়তেই দেয় না আর বিএসএফ বন্দুক ফিট করে রাখে। অথচ জন্মের পর থেকে এই বত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত ওর জীবনে এমন একটা দিন নাই যে, মহানন্দায় যাবার বাকি নাই। শুরুটা হয়েছিল বাজানের হাত ধরে। মহানন্দার বুক ফেড়ে পাথর তুলত বাজান আর ও দুই চোখ ভরে সেই পাথর দেখত। আস্তে আস্তে শরীরটা যখন নাড়াচাড়া দিয়ে উঠল, ও-ও শুরু করল পাথর ওঠানো। ধীরে ধীরে সেই পেশাটা যে কবে নেশা হয়ে গেল, নিজেও জানে না। পরে বাপ মরল মা মরল, বিয়ে করে নতুন সংসার করল কিন্তু পাথর ওঠানোর নেশাটা যেমন ছিল তেমনই আছে। একতিলও মরে নাই। আর মহানন্দাও যেমন! একদিন যেন অরে না দেখলে চলে না। রাত পোহালেই ডাকে, নাড়ির টান ধরে ডাকে, পাথর ছুঁয়ে ছুঁয়ে ডাকে! ওর বুকের মধ্যে যে কত পাথরের ঘর-সংসার! যত তোল পাথর আর শেষ হয় না। এই যে ইন্ডিয়ান সরকার নদীর মধ্যে বাঁধ দিল, পারছে পাথর আসা বন্ধ করতে? একচুলও পারে নাই। কোথ্ থেকে যে এত পাথর আসে আল্লাহ্-খোদাই জানে! সেই পাথর যখন ফয়জুর তোলে, তখন সেটা আর পাথর থাকে না। পেটের দানা হয়ে যায়। সেই দানায় আজ ভাগ বসাতে এসেছে দালালের দল। রাজনীতির নামে লুটেরার দল পাথর থেকে আজ রস বের করতে চায়। ওদের সঙ্গে জুটেছে মস্তান আর ফড়িয়া। জুটেছে বিএসএফ, বিডিআর-এর লোকজন। শিয়ালের কামড়াকামড়িতে ঘটনা ঠিক কী ঘটেছে ফয়জুর জানে না। প্রায় মাস দুয়েক আগে বিডিআর হঠাৎ মহানন্দার বুক থেকে পাথর ওঠানো বন্ধ করে দিল। ওদিকে বিএসএফও আরও একধাপ এগিয়ে হুকুম জারি করল, মহানন্দায় নামলেই গুলি!
বিডিআর বিএসএফ-র মধ্যে মাঝে মাঝেই গোলাগুলি হয়, কিন্তু পাথর নিয়ে এরকম টানাহেঁচড়া সারাজীবন দেখেনি ফয়জুর।
রাত দিন যাদের কাটে মহানন্দায় সাঁতরিয়ে সাঁতরিয়ে, তাদের পক্ষে কি একদিন না গিয়ে থাকা সম্ভব? আর মহানন্দায় নামলে যে সত্যি সত্যি বিএসএফ গুলি করবে, এটাও ঠিক কারোরই বিশ্বাসে ছিল না। মাঝিপাড়ার বদরুল একদিন একা একাই নেমে পড়েছিল। দশ মিনিট যেতে না যেতেই গুলির আওয়াজে পুরো তেঁতুলিয়া থমকে গেল। বদরুলের রক্তে সেদিন লাল হয়ে গেল মহানন্দার পানি। লাশটাকেও ফেরত দিতে চায় নি ওরা। বিডিআর বিএসএফ-এর মধ্যে এ নিয়ে কত ফ্ল্যাগ মিটিং, রশি টানাটানি। লাশ যদিও ফিরে পাওয়া গেল কিন্তু মহানন্দায় নামার বিশ্বাসটুকু হারিয়ে গেল সবার। বিশ্বাস হারালেও কি একটানা সাতাশ বছরের অভ্যাস মরে যায় কারো! ফয়জুরের রক্ত মাঝেমধ্যেই ছলকে ওঠে মহানন্দার ডাকে, হাওয়ার ইশারায়। আজকাল সে ইচ্ছেটাকে আরও মাথাপাগল করে দিয়েছে শরতের আকাশ। নীল শরতের সাথে সাদা মেঘের ছায়ায় যখন একটা মিষ্টি কনকনে হাওয়ার আমেজ এসে লাগে গায়, তখন আর ঘরে বসে থাকতে একদন্ড মন চায় না। ও বেপরোয়া হয়ে উঠল, ‘মোরে আর বাঁধা দিস না আকলি। মোর কিছুই ভালো লাগে না। মহানন্দায় না নামলে যে মুই মরে যাবো!’
‘মরলে মোর সামনেই মরেন! ওই পানির মইধ্যে গুলি খেয়ে মরার দরকার নাই। মোর সহ্য হবে না।’ সামনের পথ থেকে কিছুতেই সরে না আকলিমা।
‘এত বড় মহানন্দায় মোর মতো একজন ছোট মানুষ গেলে কিছুই হবে না। ওরা মোরে কিছুই বলবে না। তুই মোরে ছাড়!’
আকলিমার বাঁধা পেরিয়ে যখন ফয়জুর বেরিয়ে যেতে চাইল, এক ঝটকায় পেটের ওপর থেকে শাড়ি সরিয়ে ফয়জুরের একটা হাত সেখানে রেখে আকলিমা বলল, ‘আজ যদি মহানন্দায় যাইস তো পেটের বাচ্চার মাথা খাস।’
‘অ্যাঁ! কি কইস? কি কইস?’
কথাটা দ্বিতীয়বারের মতো বলতে পারল না আকলিমা। লজ্জা-সংকোচে ওর মরে যাওয়ার দশা হলো। কাছে এগিয়ে এলো ফয়জুর, ‘মুই বাপ হম্? মুই বাপ হম্? তুমি মোরে আগে কহিস নাই ক্যান আকলিমা!’ আবেগে ওর কোমর ধরে উঁচুয় উঠাল, তুলে ধরতে চাইল যেন হেই আকাশের তল পর্যন্ত!
আকলিমা হাসতে হাসতে বলল, ‘ছাড়েন ছাড়েন! পড়ে যাব তো!’
বেশ একটা ঘোরানি দিয়ে মাটিতে নামাল ওকে। মুখের কাছে মুখ নিয়ে মধুর কন্ঠে বলল, ‘আগে কহিস নাই কেন?’
আকলিমা ওর বুকে মুখ লুকিয়ে বলল, ‘বুঝতে পারেন নাই?’ ফয়জুরের গলায় ভালো লাগার তীব্র একটা আবেশ, ‘কী রকম কী রকম জানি লাগতেছিল! বুঝতে পারি নাই।’
দুই.
কিন্তু পরের দিন ওকে আর কিছুতেই ধরে রাখতে পারল না আকলিমা। ঘুম ভাঙতেই ও সকালের আবছা আলোয় দেখতে পেল কাঁধে গামছা, টায়ার হাতে তেল চকচকে ফয়জুর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। ও শোয়া থেকে উঠে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই মানুষটা উঠানে। কোন সময়ে উঠল, তেল মাখল গায়ে, কিছুই বলতে পারবে না। কাল সারা রাত পেটের ব্যথায় ঘুমাতে পারেনি। তাই মরার ঘুমে বেহুঁশ হয়েছিল সকালবেলা। বাঁধা দেয়ার শক্তিটুকুও যেন নাই। তাছাড়া একটা অভিমানও দলা পাকিয়ে উঠল বুকের ভেতর। একটা লোকেরে কত বুঝান যায়? কতই আর জোর খাঁটান চলে? ওর কথা না হয় না-ই ভাবল, পেটের বাচ্চার কথাটা তো একবার চিন্তা করবে! মহানন্দায় গেলে কি আর ফেরত আসতে পারবে! থমকে দাঁড়ানো ফয়জুর ওকে সান্ত¦না দেয়, ‘আমি একা মানুষ মহানন্দায় গেলে কি হবে! মুই তো আর পাথর উঠাইতে যাচ্ছি না, যাচ্ছি মনটারে হাওয়া লাগাইতে।’
মনে মনে আকলিমা রাগে ফায়ার হয়ে যায়। পাথর উঠাইতে যাবেন না, তাইলে টায়ার নিছেন কেন? রাগে কথাও বলতে ইচ্ছে করে না ওর। হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘তোমা যা মন চায় করো, মুই আর কিছু কহিম না।’ মনে হলো না কথাটা ফয়জুরকে ধরল। ও ফিরেও তাকাল না পেছনে। সামনের দিকে দ্রুত পা চালাল।
ফয়জুর যে মহানন্দায় নামার জন্যে এতটা বেহুঁশ হয়ে যাবে, কল্পনায়ও ছিল না আকলিমার। প্রায় মাস দুয়েক আগে যখন গ্রামসুদ্ধু মানুষ বিএসএফ-এর তাড়া খেয়ে মহানন্দা থেকে ঘরে ফিরল, তখনো ফয়জুরের মুখে সে কী হাসি। প্রাণের ভয়ে কে কী রকম কান্ড কীর্তি করল, কে জানটা হাতে নিয়ে লুঙি ফেলেই দৌড়ে পালিয়ে এসেছে-সেসব কাহিনী শোনাতে শোনাতে মানুষটার হাসি আর থামতেই চায় না। মহানন্দায় যে নামতে দেবে না ব্যাপারটা ওর কল্পনাতেও ছিল না। বত্রিশ বছরের জীবনে নাকি এ রকম কা- কখনো দেখেনি। পরদিন সকালেই টায়ার হাতে প্রতিদিনের মতো রওনা হয়েছিল মহানন্দার দিকে। আধা ঘণ্টা পর মুখ গোমড়া করে ফিরে এলো। ওর পাশে হাত পা ছেড়ে দিয়ে সেই যে বসল, আর কি উঠতে চায়! বিএসএফ-এর জওয়ানরা নাকি বন্দুক হাতে টহল দিচ্ছে। পজিশন নিয়েও বসে রয়েছে দুই-চাইর জন। নামলেই গুলি!
নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে দিল মানুষটা। আকলিমাই ওকে জোর করে গোসল করাল, খাওয়াল। কিন্তু মুখের সেই হাসিখুশি ভাবটা আর দেখতে পেল না। কেমনে হবে কালা মুখ সাদা! যে মহানন্দায় থাকত হাজার হাজার লোকের কোলাহল, সেই মহানন্দা কেমন থম মেরে গেছে। নদীর পারে লোক তো লোক, একটা হাঁসের বাচ্চা যাওয়ার সাহস পায় না। এই পাশে বিডিআর, ওইপাশে বিএসএফ বন্দুক কাঁধে নিয়ে সমানে ঘোরে। গোখরার মতো ছোবল মারার জন্য খালি ফোসফাস করে!
ফয়জুর এক পা যায় তো দুই পা পিছায়। ছটফট করে। এর-ওর বুঝ নেয়। কে কারে বুঝ দেবে! সারা তেঁতুলিয়ার মানুষই তো হঠাৎ রোজগার বন্ধ হওয়ায় বোবা হয়ে গেছে। কোনো দিশা পায় না। বসে বসে ঝিমায়। এদিকে-ওদিকে কান পাতে। কোনো আশার খবর যদি শোনা যায়! আর আশার খবর! গুজবের হাওয়ায় গরম থাকে তেঁতুলিয়ার বাতাস। সরকার পাল্টাইছে তাই বর্ডারের অবস্থাও পাল্টাইছে। ইন্ডিয়ার সাথে এই সরকারের সম্পর্ক ভালো না। যেকোন সময় একটা গন্ডগোল লেগে যেতে পারে। সেই সব গুজবের নমুনাও অবশ্য মাঝে সাঝে পাওয়া যায়। মাঝিপাড়ায় চা-বাগান করা নিয়ে সেই দিন কী গোলাগুলির ঘটনাই না ঘটে গেল! সেই দিন একজনের মুখে শুনল, উত্তর বর্ডার দিয়ে গরু আনা বন্ধ করে দিছে। আকলিমা নিজের চোখেও দেখল, ইন্ডিয়ান বর্ডারের চারদিকে বড় বড় লাইট জ্বালিয়ে রেখেছে ওরা। কী যে পাওয়ার সেই লাইটের, আশপাশের দশগ্রাম পর্যন্ত আলো হয়ে থাকে। লাইটের আলোয় সজাগ থাকে পুরা গ্রাম। উঠানে বসে বসে সেই লাইটের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে ফয়জুর। এই আলো না থাকলে হয়তো রাতবিরাতে মহানন্দায় নেমে গাটা জুড়াতে পারত। মহানন্দার পানিতে না ভিজালে কি গা টালকা হয়? আরো কত রকমের যে ওর ক্ষোভ, রাগ,- মহানন্দা কি কারো বাপ-দাদার সম্পত্তি যে নামতে দেবে না। এটা যেমন ইন্ডিয়ার সম্পত্তি তেমনি বাংলাদেশেরও- দুই পক্ষেরই সমান হক! ভেতরের রাগ-ক্ষোভ যে আজকাল ওর সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে, কদিন ধরেই বোঝা যাচ্ছিল। সেটা যে আজ এত চরম হবে, ধারণাই করেনি আকলিমা। যাক, গেছে যখন যাক। সতিনের কোলে সাঁতরিয়ে সাঁতরিয়ে ইচ্ছামতো গা জুড়িয়ে আসুক। শুধু রক্তগঙ্গা না বইলেই হয়! মনে মনে দোয়া করল আকলিমা।
মহানন্দা পর্যন্ত নির্বিঘ্নেই পৌঁছাল ফয়জুর। কেউ বাঁধা দিল না। এমনকি নদীর ধারে-কাছে কোনো বিডিআরও চোখে পড়ল না। ওরা হয়তো ধরেই নিয়েছে, নিজের জীবন বাজি রেখে কেউ এদিকের পথ সহজে মাড়াবে না। শান্ত নিস্তব্ধ মহানন্দাকে দেখে বুকের ভেতরটায় কেমন মুচড়ে উঠল ফয়জুরের। মনে হলো মহানন্দা বুঝি মরে গেছে। ওর ঘুম বুঝি কোনোদিন আর ভাঙবে না। না না। মরতে পারে না মহানন্দা। ওর ঘুম ভাঙাতে হবে। ওকে জাগিয়ে দিতে হবে। আবার ঢেউয়ে ঢেউয়ে নেচে উঠবে ও। ফয়জুর হাতের টায়ার আর বেলচা পাড়ে রেখে ঝাঁপিয়ে পড়ল মহানন্দার বুকে। ডুবে ডুবে সাঁতরে সাঁতরে তোলপাড় করে দিতে লাগল মহানন্দার পানি। অদ্ভুত এক শান্তিতে ওর গা ঠাণ্ডা হয়ে গেল।
চেনা শরীরের স্পর্শ পেয়ে মহানন্দাও যেন জেগে উঠল হঠাৎ। নতুন করে আন্দোলিত হলো। ঢেউয়ের পর ঢেউ ছড়িয়ে পড়তে লাগল দূর থেকে আরো দূরে। এই মহানন্দার পানিতে গোসল করতে করতে ওর কচি শরীর পরিণত হয়েছে। কিশোর শরীর পেয়েছে যৌবন। কত কথা যে টুকরো টুকরো ভেসে উঠল চোখের সামনে! বাবার সঙ্গে যেদিন প্রথম মহানন্দায় নেমেছিল, সে-স্মৃতি আজ আর মনে নাই। তবে মনে আছে সে দিন খুব নাকানি-চুবানি খেয়েছিল। ডুবেও যেতে চেয়েছিল একবার। তবু বাপ ওরে ছাড়ে নাই। সে দিনই যেন সাঁতার শিখিয়ে ছাড়বে। তারপর সাঁতার তো সাঁতার! একদিন মহানন্দাই হয়ে উঠল ওর জীবন-জীবিকা। তা না হলে একদিন যদি মহানন্দায় আসতে না পারে, বুকটা ধস করে উঠবে কেন? আজ যেন সমস্ত নদীটা ওকে আছড়ে দেবে, সোহাগে ভরিয়ে দেবে।
হঠাৎ ‘হল্ট’ শব্দ শুনে চমকে উঠল। চার-পাঁচজন বিএসএফ ওর দিকে বন্দুক ধরে আছে। উথাল-পাথাল সাঁতরাতে সাঁতরাতে কখন চলে এল ভারতীয় সীমান্তের এত কাছে! ভয় পেল না ফয়জুর। মহানন্দার কোলে-পিঠে মানুষ। বিএসএফকে কি ওর ভয় পেলে চলে? জীবনে কী কম বিএসএফ-এর সঙ্গে কথা হয়েছে। শিখ রণবীর সিংকে কোনোদিন ভুলবে না। ওর সঙ্গে দেখা হলেই কুশার খেতে চাইত। বিনিময়ে ভারতীয় সীমান্তের ভেতরে ঘুরে আসার সুযোগ মিলত। এ রকম কত জনের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, কথা হয়েছে। ফয়জুর হেসে হেসে বিএসএফ-এর উদ্দেশে চিল্লায়ে বলল, ‘মহানন্দায় না নামলে গা ঠাণ্ডা হয় না দাদা…’
ওর কথা ভেসে গেল একজন সোলজারের চিৎকারে, ‘ওঠো! রোখ যাও! নামো মাত! বানচোত?’
‘গাইল দ্যান ক্যা দাদা! আমি একলা নামলে কি অয় মহানন্দার?’
‘হাট যাও! হাট যাও! বাইনচোত কাহাকা! গোলি মার দেইঙে।’
থম মেরে দাঁড়িয়ে যায় ফয়জুর। নমুনা তো ভালো লাগতেছে না। এমনভাবে পজিশন নিয়ে আছে, গুলি যেন করেই ছাড়বে, বিশ্বাস হয় না ফয়জুরের, ওকে কেউ গুলি করতে পারে, কিছুতেই বিশ্বাস হতে চায় না।
মানুষটা বেরিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই রাঁধতে বসেছিল আকলিমা, তার আগে গিয়েছিল ব্যাপারী বাড়ি। ধারে এক পোয়া চাল এনেছিল, সেটাই চড়িয়ে দিয়েছে চুলায়। দুই দিন যাবৎ ভাত খাওয়া হয় না। আজ মহানন্দায় মানুষটা নামছে, ব্যবস্থা একটা হবেই। ঘরের পাশের চাল থেকে লাউ শাক তুলে এনেছে। লাউ পাতার ভর্তা দিয়ে ভাত খাইয়ে মানুষটারে চমকে দিতে চায়। লাকড়ি আর জ্বলে না। জ্বলতে চায় না। কত জ্বলব! ও পাটশলা ঠেলে দেয় চুলায়।
ভাত শেষ করে মাড় গলাতে বসিয়ে যখন লাউ পাতা সিদ্ধ করতে দিয়েছে, তখনই অনেকগুলো পায়ের শব্দ পায় আকলিমা। অনেকগুলো পায়ের শব্দ যেন এগিয়ে আসছে বাড়ির দিকে! বুক ধস-ধস কেঁপে ওঠে। কিছু হলো না তো মানুষটার? শব্দ যত কাছে এগিয়ে আসে, ততই বুকের ধস-ধস বেড়ে যায়। ঝট করে ও ওঠে দাঁড়াল, আর তখনই হাসিমুখে দেখা গেল মানুষটারে। যেন রাজ্য জয় করে ফিরেছে! সঙ্গে হারুন, নবা, শফি! সবার মধ্যেই অতি আনন্দ। প্রায় দুই মাস পর বিডিআর-বিএসএফ-এর সকল চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে মহানন্দায় নেমেছে ফয়জুর। ওর চোখে মুখে চরম উত্তেজনা। ‘দেখছ আকলি! খালি খালি ভয় খাইছ। এই মাথা থেকে সেই মাথা সাঁতার কাটে এলাম! কী! হলো কিছু!’
ওর খুশি দেখে খুশি হয় আকলিমা আবার মনের মধ্যে প্রশ্ন ভেসে ওঠে, পাথর তুলতে পারে নাই মানুষটা? কিছু জিগ্যেস করতেও সাহস পায় না। ওর মনের কথা যেন পড়তে পারল ফয়জুর। বারান্দায় বসতে বসতে বলল, ‘আজকে প্রথম গিয়ে ভাবটা বুঝলাম। কালকে দেখি পাথর উঠাইতে পারি কিনা!’
সেই আগের খুশি আগের হাসি যেন ফিরে এসেছে! নবা, শফিরা হুড়মুড় করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। ফয়জুর ধাপে বসেই অস্থির গলায় চিল্লায়ে উঠল, ‘খাবার দাও। পেটটা জ্বলতাছে। আগে পেট ভরে খেয়ে নেই। তারপর আলাপ!’
চার.
পরদিন সাত সকালে বিছানায় শুয়ে শুয়েই আকলিমা দেখল মানুষটার তেল মাখানো। আজ আর বাঁধা দেয় না। কাল মহানন্দায় নামার পর থেকেই কী রকম কী রকম জানি বদলে গেছে। আনন্দে মন গুলগুলা। যে মানুষটা দুই মাস ধরে থুম মেরে শুধু উঠোনে বসে থাকত, সে কাল সারা পাড়া ঘুরে এসেছে, যেন জানান দিতে, সারা রাজ্য জয় করার। এতই যদি ভালো থাকে, তাহলে ও বাঁধা দেয়ার কে? যাক না! তুলে আনুক পাথর। সতিনের কাছে আজ ছেড়ে দিতে কোনো ভয় নাই ওর। কাল মানুষটা পাথর তুলতে পারে নাই। কিন্তু সন্ধ্যা বেলা কোথ থেকে যেন কীভাবে আতপ চাল আনছে কুশার গুড় আনছে ব্যাগ ভরে। ক্ষীর বড়ই পছন্দ করে! কতকাল খায় না! আকলিমা শুয়ে শুয়ে ভেবে রাখল আজ উঠেই ক্ষীর রাঁধবে। নমুর মার কাছ থেকে আধা সের গরুর দুধ ধার আনবে! সতিন বলে কথা! যেন তর সইছে না মানুষটার! তেল মাখানো শেষ করেই টায়ার আর বেলচা হাতে ঘর থেকে দুপ দাপ বেরিয়ে যায়।
কতদিন পর আতপ চাল! যত্ন করে ধুয়ে নিল আকলিমা। চালের সাথে দুধ মিশাল। তারপর চড়িয়ে দিল চুলায়। ক্ষীরের যে কী পাগল মানুষটা। পারলে এক পাতিল ক্ষীর খেয়ে ফেলে একাই। নতুন নতুন যখন ওদের বাড়ি নাইওর যেত, কিসের পোলাও-মাংস! ক্ষীর হলে পরে আর কিছুই লাগত না। সেই ক্ষীর তিন চার মাস হলো বন্ধ! পেটের ভাতই জোটে না! আবার ক্ষীর!
পানি যখন বলক মারতে শুরু করেছে, চাল শুরু করেছে ফুটতে, তখনই একটা গুলির শব্দ ভেসে উঠল দূরে কোথাও। র্স র্স করে পাখিগুলো যেন উড়ে গেল। গাছের পাতায় পাতায় যেন কাঁপন লাগল। দপ করে উঠে দাঁড়াল আকলিমা। না না না! এসব ও কী ভাবছে? কোথায় গুলির শব্দ! গুলি হবে কেন? মনের খটকা! মনের ভয়কে ও পাত্তা দিল না। কতদিন পর মানুষটা ক্ষীর খাবে! ও আবার চুলোর পারে ঘন হয়ে বসল। যদি কালকের মতোই তাড়াহুড়ো করে ফিরে আসে! এক মিনিটও ক্ষুধা সহ্য করতে পারে না। চুলায় আবার পাটশলা ঠেলে দেয়। আগুন উস্কে ওঠে।
বাহ! কী সুন্দর সুবাস বের হয়েছে ক্ষীরের! আকলিমা যখন ঘ্রাণ শুঁকছে প্রাণ ভরে তখনই আবার অনেকগুলো পায়ের শব্দ শোনা যায়। ধব ধব! বড় ভারি ভারি পায়ের শব্দ। আকলিমা আবার পাটশলা ঢুকিয়ে দেয় চুলায়। ফিরে এসেই যে মানুষটা ধাপে বসে খাবার চাইবে!
পায়ের শব্দ আরও এগিয়ে আসে। আরও ভারি। সেই সঙ্গে একটা হাহাকার জড়ানো কোলাহল! আরও কাছে শব্দটা। একেবারে ঘরের পাশ ঘেঁষে! আকলিমা এড়াতে চাইল শব্দটা। আরো বড় বেশি ব্যস্ত হয়ে উঠল রান্নায়, এখনই তো খেতে চাইবে মানুষটা! ঢাকনা সরিয়ে ও দেখে নিল ক্ষীরটা ঘন হয়েছে কিনা!
আরও পড়তে পারেন……