রাজেশ ধর ।।
এখানে একটা নদী আছে, নাম চুপি। চুপিতে এখনো জোয়ারভাটা খেলে। জোয়ারভাটা তো নদীতে খেলবেই। কিন্তু মল্লিকদাদু…আমাকে দেখলেই ডাকে। তারপর বলে, “ কীরে মধুর নাতি, দাদু কেমন আছে? নদীতে যেতে পারে এখনো মাছটাছ ধরতে? ছোটবেলায় নদীতে, বিলে ডোঙা নিয়ে একসঙ্গে কত মাছ ধরেছি…” মল্লিকদাদু নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে, আমিও তাকাই চুপির দিকে। হয়তো সকালের মেঘলা আকাশের রঙে চুপিকে তখন সবজে দেখাচ্ছে, ভাটির টানে কচুরিপানাগুলো ফিরে যাচ্ছে তাদের পুরোনো জায়গায় যেখান থেকে আবার জোয়ারের টানে তারা ফিরে আসবে। নয়তো বিকেলের লাল আলো নিভে যাওয়া ছাই ছাই আকাশ আর একটু হলেই নেমে আসবে চুপির বুকে।
মল্লিকদাদু সকাল-বিকেল নদীর ঘাটে আসে। কলকাতার কোন বড় কলেজে নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোল পড়াত মল্লিকদাদু। আমাকে প্রায়ই বলে, “ ওরে তোদের এই চুপিতে যতই জোয়ারভাটা খেলুক…এটা মরবেই। ডেলটার ব্রাঞ্চগুলোতে পলি পরতে পরতে একদিন সব শুকিয়ে যায় রে…” তখন কি মল্লিকদাদুর চোখ চিকচিক করে! আমি চুপ করে দেখি…একটু দূরে বেঁধে রাখা আমাদের মাঝারি নৌকাটা চুপির ছোটছোট ঢেউয়ের ধাক্কায় দুলছে। মাঝেমাঝে তার থেকে মাছের আঁশটে গন্ধ ভেসে এলেও চুপির হাওয়া তাকে গলা ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে নিয়ে যায়। পনেরো বছর বয়স হলেও এই গ্রাম আর মামাবাড়ির মহকুমা শহর ছাড়া আর কোথাও যাই নি। মামাবাড়ির ওখানেও একটা নদী আছে ,সেটাতেও জোয়ারভাটা খেলে কিন্তু ঐ ঘিঞ্জি জায়গাটার মতই সেই নদীটাকে দেখলে আমার খুব মনখারাপ হয়।বীরেশদা বলে ওটাও নাকি চুপি। আমার বিশ্বাস হয় না। সারাদিন আকাশের রঙবেরঙের শাড়িতে যে চুপি সাজে, সে কখনো অমন কালচে ঘোলাটে গোমড়ামুখো হয়ে থাকতে পারে? বীরেশদা আমার বোকামিতে হেসে ফেলে।
মল্লিকদাদুও জানে আমার লেখাপড়ার দৌড় তবুও ভূগোলের কতকিছু বলে! আমি সেই চুপ করেই থাকি।তারপর হঠাৎ করে থেমে গিয়ে বলে–
“ আজ কী কী মাছ উঠল?”
“ বাগদা, আঁশ ভাঙন, সোনা ট্যাঙরা…”
“ সোনা ট্যাঙরাগুলোর মাথায় বালি ভর্তি, নদীর বাগদাগুলো বড্ড সরু!”
“ কিছু মাছ আজ দিয়ে আসব আপনার বাড়িতে, দাদু বলেছে।” মিথ্যেই বলি, কারণ নদী থেকে ফিরে মাছ নিয়ে বাবা নিজে গেছে ব্লক টাউনের বাজারে। আর আমি চুপির কাছেই বসে গিয়েছিলাম, তখনই দেখা মল্লিকদাদুর সঙ্গে। ‘ছোট মল্লিকের’ প্রসঙ্গ আসলে আমার দাদু্র কথা থামতেই চায় না, তার মাছ ধরার কেরামতি আর মাছ খেতে ভালবাসার অনেক গল্প আমার মুখস্থ ।মাঝেমাঝে দাদু , বাবাকে বলে , “ বাঁটুল, নদীতি ভালো বোল, পারশে আর গলদা পড়লি, ছোট মল্লিক্কির দে আসবা। সে বড্ড ভালবাসে তোমাগে।”
নদীর দুপাশভর্তি ভাটা আর জলকরের কথা দাদু জানে, তবুও তার আমলের মাছ যে আর নেই তা তাকে বিশ্বাস করানো যায় না।মল্লিকদা চুপ… তার নজর আবার নদীর দিকে। অনেকটা সময় কেটে যায়, ঝাঁঝাঁ রোদ্দুরের তাত ঝাকড়া বটগাছটার পাতার ফাক দিয়ে ছ্যাকা দিতে থাকে। মল্লিকদাদু প্রায় ফিসফিস করে বলে, “ জোয়ার-ভাটার তেজ দিনদিন কমে যাচ্ছে না ? এত তাড়াতাড়ি!” তারপর আমার কথা শোনার জন্য যেন আর কোনো ইচ্ছাই থাকে না তার।মহকুমা শহরের রাস্তায় দেখা পাথরের মূর্তিগুলোর মত লাগে তাকে। আমি সারাদিন বয়ে চলা চুপির স্রোতের কথা ভাবতে থাকি, ষাঁড়াষাড়ির বান, পূর্ণিমা আর অমাবস্যার ‘গোন’ –এর কথা ভাবি, ভাটির স্রোতের কথা ভাবি, কই আমার তো মনে হয় না চুপির স্রোত কমে যাচ্ছে? দিনে, রাতে, চর পেরিয়ে ডাইনে বাঁয়ে প্রায় দু-তিন কিলোমিটার জুড়ে জাল ফেলি বাবার সাথে। চুপির জল আমায় টানে। মাঝরাতে জোছনা চিকচিক করলে জলের ঢাকনা সরিয়ে চুপির বুকের ভেতরে ডুব দিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে…কী আছে ঐ জলে যা আমায় দিনরাত টেনে আনে তার কাছে। দমবন্ধ করে বসিয়ে রাখে নৌকায়, ঘাটে। পাড়ার বন্ধুবান্ধব আমায় দেখলে বলে, “শালা তারকাটা, মাথায় টাল আছে।” ওতে আমার মনে কিছু হয় না , কিন্তু আজকাল মল্লিকদাদুর ঐ কথা মনে করলে ভয় লাগে, চুপির স্রোত কি কমে যাচ্ছে? এভাবে চলতে চলতে যদি একদিন…! কিন্তু মল্লিকদাদুই তো বলেছিল সে অনেকদিন পরে হবে, অন্তত আমার জীবন কেটে যাবে।
দুই.
এই গ্রামে প্রথম আসি বছর চারেক আগে। চুপির ওপরে যে ব্রিজটা, এখন ব্লক টাউনে তৈরি হচ্ছে সেটা তখন এই গ্রামের ওপর দিয়ে হওয়ার কথা ছিল।ন্যাশানাল হাইওয়ে অনেক সহজে ধরা যেত, অনেক লাভজনক হত প্রজেক্টটা। জেলার চিফ ইঞ্জিনিয়ারকে নিয়ে এসেছিলাম স্পট দেখাতে আরো ছিল অনেকেই। এম এল এ বিশুদা, সভাপতি খোদাবক্সো ভাই,পার্টির ছেলেরা, ব্লক অফিসের লোকজন। সাহেবের পছন্দ হল, রিপোর্ট জমা পড়ল। তারপরে জমি আন্দোলন, অনেক গল্প। চলে গেল ব্রিজ। আমার তেমন ক্ষতি হয় নি, আবার হয়েছেও। সাহেব বদলি হয়ে গেল। সাব কন্ট্রাক্ট পাব বলে,সাহেবের জন্য যা ইনভেস্ট করেছিলাম সেটা গেল। নতুন সাহেব জেলার নেতা বিষ্ণুদার লোক। আর পেলাম না কাজ।তবুও কোনো দুঃখ নেই। যেদিন জানলাম ব্রিজ হচ্ছে না, বুক থেকে একটা পাথর নেমে গেল।
সাইট দেখা হয়ে গেলে, সেদিন ফিরব। সাহেব,এম এল এদের গাড়িগুলো এগিয়ে গেছে। বাইকটা স্টার্ট করতে গেলাম, বন্ধ হয়ে গেল। দেখি, খেয়াঘাটের ঝাকড়া বটগাছটার, মোটা শেকড়ে পা-ঝুলিয়ে বসে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে একটা বছর চোদ্দো-পনেরোর কাদামাখা বারমুডা আর গেঞ্জি । আমিও ছেলেটার নজর বরাবর তাকালাম।বিকেলের আবছা আলো-অন্ধকারে নদীর নীলচে স্রোত, ওপারে উচু ডাঙায় ঘন সবুজ ঘাসে তখনও দু-একটা গরু,কয়েকটা কাক ফিরে আসছে এপারে। আচমকা আমার শিরার মধ্যে বিদ্যুতের স্রোত বয়ে গেল। আমার নাড়িপ্রান্ত উপড়ে উঠে আসবে মনে হল। আমি ছেলেটার পাশে বসে পড়লাম।
ছেলেটার নাম পলাশ। ওই গ্রামের একমাত্র জেলে পরিবার যারা এখনো মাছ ধরে, তাদের ছেলে। টিকে থাকার জন্য পলাশকেও বাবার সাথে লড়তে হচ্ছে। কিন্তু বাবার কাছে ও রোজ বকা খায়। ওর নাকি মাছ ধরায় মন নেই। বাবার অভিযোগ- ও শুধু নদীর স্রোতের দিকে তাকিয়ে থাকে। এখনও নদীর বুকে ফেলা জাল গোটাতে শিখল না।লেখাপড়াতেও মন নেই, মাথা নেই। ওকে নিয়ে বাবার চিন্তার শেষ নেই। মাঝেমাঝে বলি-
“ পড়াশোনা ছেড়ে দিলি, কাজেকর্মে মন নেই। তোর কী হবে?
বলি বটে তারপর ভাবি পনেরো বছরের ছেলেকে ভাবতে হবে ভবিষ্যত! ও কিন্তু উত্তর দেয়-
“ বীরেশদা যাই করো, বাবার কথা শুনে এই গ্রাম ছাড়িয়ে আমায় নিয়ে যেও না…” দেখা হলেই পলাশের বাবা, আমার কোনো একটা সাইটে ওকে কাজে নেওয়ার কথা বলে।
চুপ করে থাকি, সত্যি বলতে পারি না। এই কবছরে একে একে পাঁচটার মধ্যে চারটে সাইট বন্ধ হয়ে গেছে। কোথায় কাজে নেব ওকে। নিজেকে প্রশ্ন করেছি। দেখেছি, মাঝরাতে বমি করার সময় বেসিনের সামনের আয়নার ভেতরে যে জন্তুটা আমার দিকে তাকিয়ে থাকত সে আর আমায় দিয়ে আর মদের বোতল, মেয়েছেলে , নোটের বান্ডিল সাপ্লাই করাতে পারছে না। পি ডব্লু ডির ফাইলে আর কাটাকুটি করাতে যাচ্ছি না আমি। ব্যাবসা থাকে কী করে! একটু ফাঁক পেলেই সেই চল্লিশ কিলোমিটার দূর থেকে চলে আসি এই নদীটার পাড়ে।মাঝদুপুরে কিম্বা কানা রাতে নদীর পাড়ে বসে থাকি।পলাশ আর রবিউলের সঙ্গে মাইলকয়েক ধরে ছড়ানো চুপির পাড়ে বসে থাকি।আমার আর বাড়ি ফিরতে ইচ্ছা করে না!
বৌ, বন্ধুবান্ধবদের দিয়ে খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হয়েছে কোনো মেয়েছেলের পাল্লায় পড়িনি।একদিন বলে ফেলেছিলাম, এখানে নদীর পাড়ে একটা বাড়ি করব। কদিন খুব অশান্তি! তারপর রফা হয়েছে যত রাতই হোক না কেন বাড়িতে ফিরতেই হবে!
সেই প্রথমদিন পলাশের পাশে বসে পড়েছিলাম, অনেকক্ষণ পরে ও আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল-
“ নদীর বুকে ব্রিজ হবে?” আমি মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলেছিলাম। ও বলল, “ স্রোত কমে যাচ্ছে, কাজের সুবিধা হবে?”একটা উল্টো ঝঁকুনি খেয়েছিলাম। স্রোত কমে যাচ্ছে মানে? চুপিতে তো জোয়ারভাটা খেলে? ছেলেটা বলে কী?
“ কী যাতা বলছ?”
“ মল্লিকদাদু যেদিন প্রথম বলেছিল আমিও বিশ্বাস করিনি। কিন্তু সত্যি! তাই যে হচ্ছে…একবছর আগেও ভাটির টানে সেকেন্ডে পাঁচ-ছটা ঢেউ, পাড়ে এসে ধাক্কা মারত, আর এখন সেটা একটা কি দুটো। ভাল করে দেখুন!” সেদিন সেই অলৌকিক অনুভূতির পালা চলছিল, মাথার ভেতরটা আস্তে আস্তে ফাঁকা হয়ে যাচ্ছিল… ঢেউ গুনতে শুরু করেছিলাম।অনেকক্ষণ পর পলাশ উঠল, বললাম—
“ চলে যাচ্ছ?”
“ সারাদিন আমিও গুনছি, লাভ নেই…বাড়ি না গেলে বাবা মারবে।”
মল্লিকদাদুর সঙ্গে পরিচয় হলে বললেন—
“ আপনারা ব্রিজ বানিয়ে, বাঁধ দিয়ে নদীকে মারার ব্যাবসা করেন। অথচ নদীর স্রোত কমছে কিনা তা নিয়ে ভাবছেন আপনি?” উত্তরটা তো আমি নিজেই জানতাম না! চুপ করেই ছিলাম। তিনি বললেন–
“ আপনার পদবী মাজি!… তার মানে আপনার পূর্বপুরুষের সাথে এই নদীর রক্তের যোগ।” আমার পূর্বপুরুষেরা যে আসলে মাঝি সেকথাটা তিনি বুঝিয়ে দিলেন। তারপর… সারাটা রাত চুপির পারে বসেছিলাম। কান্না বুক ফাটিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছিল, চুপি যদি থেমে যায়… মাঝিরা উবে যাবে, আর মাজিরা?
তিন.
আমার নাম রবিউল ইসলাম, চাষীর ছেলে। চুপি নদীর থেকে বেশ খানিকটা দূরে মুসলমান পাড়ায় বাড়ি । পাড়ার মাওলানা সাহেবের দোতলার ছাদ থেকেও চুপিকে দেখা যায় না। পাড়ের গাছগুলোর মাথা দেখা যায় শুধু। পাড়াতে আমরা সারের দাম, মাঠের শ্যালোর জন্য বিনি পয়সার বিদ্যুত, মেয়েদের মাদ্রাসার আব্রু, শরিয়ৎ মেনে মিলাদ ইত্যাদি নিয়ে বেশ আছি। চুপির ওপারটায় শিবপুরে হিন্দুরাই বেশি, মুসলমানেরা খেয়া পেরিয়ে আমাদের মসজিদে নামাজ পড়তে আসে। চুপিকে নিয়ে কোনো আদিখ্যেতা দূরের কথা, অনেক অনেকদিন পর্যন্ত আমার অভিধানে চুপি ছিলই না।কিন্তু প্রফেসর জাইদুল চৌধুরি একদিন আমার ফোর্থ পেপারের রিসাইটেশান খাতার পেছনে একটা লেখা পরে ফেললেন।স্যারের মতে সেটা নাকি একটা কবিতা এবং আমার লেখার হাত ভালো। কলেজের ফার্ষ্ট-ইয়ারে রেহানা নামের একটি বে-আব্রু মেয়েকে দেখে ঐ কয়েক লাইন লিখে ফেলেছিলাম।
স্যার বুঝিয়েছিলেন- রোজগার, সম্মান আর আরাম-আয়েশ পেতে গেলে ঘুষ দিয়ে পাওয়া অনিশ্চিত স্কুল মাস্টারির বদলে কলেজে পড়াতে হবে। আর তাই দরকার লেখক, বিশেষত প্রবন্ধ-লেখক হিসেবে নামডাক। সার্ভিস কমিশনের শক্ত চৌকাঠ তাতে সহজে পেরোনো যায়। তিনি নিজেই চুপি নদীর প্রকৃতি আর দুপাড়ের গরীব মানুষের জীবন মিশিয়ে একটা ম্যাটার ঠিক করে দিয়ে ফিচার, প্রবন্ধ ইত্যাদি লিখতে নির্দেশই দিলেন না, সেই লেখাগুলো জেলা আর কলকাতার বেশ কিছু নামী, অনামী কাগজে ছাপার ব্যবস্থা করে দিলেন। এখন জেলায় যেকজন দলিত মুসলমান লেখক রয়েছেন তাদের মধ্যে আমিও আছি।। তাই কয়েকবছর ধরে রুটিন মেনে চুপির পাড় ধরে ঘুরে বেড়াই। জীবন দেখি,নদীর প্রকৃতি দেখি।
একদিন এভাবেই ঘুরতে ঘুরতে সন্ধের পর মরা জোছনার আলো-আধারে, বাতিল শ্মশানঘাটের চরে দেখলাম, হাটু পর্যন্ত জলে ডুবিয়ে দুজন দাড়িয়ে। এক অচেনা মধ্যবয়স্ক আর এক কিশোর।ভয়ডর কাটিয়ে কাছে গিয়ে দেখি। কিশোরকে আমি চিনি, জেলেপাড়ার পলাশ। মাঝবয়েসি লোকটা বিস্ফারিত চোখে প্রায় কাঁদকাঁদ গলায় তাকে বলছে, “ মল্লিকদাদুর কথাই ঠিক থেমে যাচ্ছে, চুপি। পলাশ… চুপি থেমে যাচ্ছে।” পলাশের যেন কোন কিছুতেই যায় আসে না, সে আরো দূরে নদীর মাঝখানে ওঠা ঘূর্ণিটার দিকে তাকিয়ে বলছে, “ বীরেশদা, মল্লিকদাদু সব জানে না। আমার মন বলছে…মানুষের যেমন টিবি হয়, ক্যানসার হয় ঠিক সেরকম… ঐ, ঐ নদীর বুকে কিছু হয়েছে গো! চলো না ওর ভেতরে গিয়ে দেখি! সেরে যাবে , আমার মন বলছে চুপি সেরে যাবে।”
আমার পাগলি নানির মুখটা মনে পড়ল। অন্ধ হয়ে পেছনের বারান্দার কোনায় গু-মুত মেখে পড়ে থাকত। চিৎকার করে মাঝে মাঝে কেঁদে ওঠে উঠত , “ ওরে আমারে চুপিতি নে চল, চ্যান করায়ে দে…ও খোদার চোখের পাক পানি। তবেই আমি মরব।” বারণ ছিল,অনেক অসুবিধা ছিল নদীতে নানির যাওয়া হয় নি। বারান্দার অন্ধকার মেঝেতেই তার জীবন থেমে গিয়েছিল।
এই নদীটাই আমার নামাজি নানির কাছে মুক্তিদাতা! কোনোদিনো তো ভেবে দেখিনি! এরই জন্য সে সৃষ্টিতত্ত্ব গুলিয়ে ফেলেছিল! কী আছে নদীটাতে? তারপরেই মনে হল, ওরাই বা অমন করছে কেন? আমি এগিয়ে গেলাম…
ওরা আমার হাত ধরে নামিয়ে দিল হাটুজলে। একটু একটু করে জল বাড়ছিল। ছেড়াছেড়া জ্যোৎস্নার জমিন ঘন হতে লাগল। আমি দেখলাম মাথার ওপরের আকাশ , ছোটবেলার ঝাঁটার কাঠি দিয়ে বানানো খেলনা ধনুকের মত ওপারের আবছা আবছা তীর বরাবর নেমে আসছে চুপির বুকে। তার শরীর থেকে তারাগুলো খসে পড়ল বলে!ঝিরঝিরে হাওয়ায় ছোট্টবেলায় পাওয়া নানির কোলের ছোওয়া পাচ্ছিলাম। একসময় জল আর আকাশের ভেতর থেকে উঠে এল নানি। দুহাত বাড়িয়ে আমায় ডাকল, “ রবি কোন গল্প শুনবা…লালকমল! নীলকমল!” নানিকে জড়িয়ে ধরতে গেলাম। কিন্তু একটা কান্নার শব্দ থামিয়ে দিল আমায়। পলাশ কাঁদছে, “ চুপি থামতে পারে না, কিছুতেই থামতে পারে না।”
তারপর থেকে বীরেশদা আর পলাশের সঙ্গে আমিও জড়িয়ে গেলাম। চুপিকে বাঁচাতেই হবে।এটা কী একটা ঘোর নাকি একটা যুদ্ধ! কিন্তু যাচ্ছি… তিনজনেই। সরকারি অফিসারদের কাছে, উকিলের কাছে, আশপাশের গ্রামগুলোতে,ব্লক টাউনে, মহকুমা সদরে– গন্যমান্য থেকে যেকোনো মানুষ যাদের এই নদীটাকে বাঁচানোর বিন্দুমাত্র ক্ষমতা আছে ।হাতেপায়ে ধরছি কিন্তু কেউ বিশ্বাস করে না…খুব তাড়াতাড়ি চুপি থেমে যাবে, আমাদের পাগল ভাবে। বীরেশদার ব্যবসাটা প্রায় উঠেই যাবে, আমারও লেখালেখি, চাকরির প্রস্তুতি এমনকি নমাজ পড়াও মাঝেমধ্যে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।পলাশকে মনে হয় ওর বাবা বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে। শুধু মল্লিকদাদুর কাছে গেলে যেন একটু ভরসা পাওয়া যায়।কিন্তু তিনি বিছানায়, কোনমতে দু-একটা কথা বলেন। বাড়ির লোকজন প্রায় দেখা করতেই দেয় না। তবুও তিনি আশ্বাস দিয়েছেন, এত শরীর খারাপের মধ্যেও কলকাতায় ফোন করেছিলেন, হয়ত কিছুদিনের মধ্যে কোনো বড় এন জি ও আসবে, চুপি বেঁচে যাবে।
সারাদিন উদ্ভ্রান্তের মত দৌড়োই তারপর সন্ধ্যা থেকে রাত চুপির এঘাটে ওঘাটে বসে থাকি। একটু একটু করে চুপির গতি কমতে দেখি। এন জি ও নামে কোনো এক ফেরেস্তার আশা আর চুপির থেমে যাওয়ার আশঙ্কা একসাথে ঘিরে রাখে আমাদের।
চার.
রবিদার ফেরেস্তা আসে নি। রোজের মত, আজও ভোর রাতে বাবার সাথে মাছ ধরতে গেলাম চুপিতে, কিছুতেই নৌকা এগোয় না। অনেকটা লগি ঠেলে কিছুটা গেছি, ভোরের আলো একটু ফুটেছে…বাবা হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, “ অনর্থ হই গেছে পলাশ, তোগে কথাই সত্যি হয়েল…চুপি থেমি গেছে!” একটুপরে শুনতে পেলাম পাড় থেকে দাদুর ভাঙা গলার চিৎকার, “ ও বাঁটুল, ও পলাশ, সব্বোনাশ হইয়েছে…ছোট মল্লিক আর নেই বলো, শিগ্গির চলি আয়!”
মল্লিকদাদুর বাড়িতে তেমন লোক হয় নি। গোটা গ্রাম আজ ভেঙে পড়েছে চুপির পাড়ে। হিন্দুপাড়ার দু-তিনটে ক্লাব কেঊ নদীর পাড়ে কীর্তন বসিয়েছে, কেউ বা পুরুত ডেকে চুপির সৎকার করছে। মুসলমান পাড়া থেকে মৌলবি নিয়ে এসে একদল দোয়া দরুদ পরেছে অনেকক্ষণ। আমরা তিনজন গিয়েছিলাম মল্লিকদাদুর বাড়ি। বাড়ির লোকেদের কাছে অবিবাহিত মল্লিকদাদু শেষ ইচ্ছা বলে গেছেন। আর আমাদের জন্য লিখে রেখে গেছেন, কাঁপাকাঁপা অক্ষরে লেখা একটা চিঠি—
“ স্নেহের বীরেশ, রবিউল, পলাশ,
লিখতে খুবই কষ্ট হচ্ছে , তবুও লিখলাম। তবে না লিখলেও কোনো ক্ষতি হত কি? কে জানে? যাক … চুপির স্রোত থামতই একদিন, তবে হয়ত এত তাড়াতাড়ি না।আমি যে বিজ্ঞান পড়েছি, পরিয়েছি সেটা যেন ভুল মনে হচ্ছিল আমার কাছে। কিন্তু যত শেষদিনের দিকে এগোচ্ছি, ততই বুঝতে পারছি। বিজ্ঞানের দোষ না, প্রত্যেকটা সেকেন্ডে আমরা যেভাবে মাটি, জল, হাওয়া, নদীকে শেষ করে দিচ্ছি, তার অবিকল পূর্বাভাস কি দেওয়া যায়! শাপলাবন বাওড়ে গিয়ে এই চুপি থামে, ঐটাই তার মোহনা। বহুকাল আগে ওই বাওড়টাও ছিল চুপির ধারা, তখন সে গিয়ে মিশত ঐ ওপারের পদ্মায়। এই বিশাল বাওড়ের জলই চুপির প্রাণভ্রোমরা । সকাল সন্ধেয় তোমাদের কারো সাথে চুপির পারে বসে থাকতাম। কথা হত খুব কম তাই এসব কথা তোমাদের বলেছি কি বলিনি মনে পড়ছে না। তাকিয়ে থাকতাম চুপির স্রোত আর ওপারের ডাঙায় ইদানিং গজিয়ে ওঠা রাক্ষুসে মাগুর চাষের ছোটো ছোটো ভেড়িগুলোর দিকে। ভাটা, বাগদার জলকর তো ছিলই নতুন ঐ নির্বিচারের মাছচাষ চুপির জল খেয়ে নিচ্ছিল হুহু করে। কিন্তু তাতেও সর্বনাশটা এত তাড়াতাড়ি আসত না।
নতুন অধ্যাপনা পেয়ে যখন বাড়িতে আসতাম, তখনই বুঝেছিলাম চুপির কী রোগ! ইচ্ছে ছিল সময় করে একটা গবেষণা করে সরকারকে দেব, তাতে চুপির জীবন আরো বেশ কিছুটা বেড়ে যাবে। কিন্তু হয় নি! দেশী বিদেশী সম্মান, উপাধি আর টাকার লোভে সব ভুলে গেলাম। যখন ফিরে এলাম তখন ভাল করে হাটতে পারছি না, চোখদুটো বেইমানি করছে। তা সত্ত্বেও মন বলছিল, জন্মভূমির ঋণ শোধ করা দরকার, তাই নদীর ধারে ঘোরাফেরা করতে শুরু করলাম। আর তাতেই একদিন পিছলে পড়লাম চুপিতে। অনেকক্ষণ জলেকাদায় বসেছিলাম তখন ভাটা… জলের টান দেখে বুঝলাম শেষের শুরুর ঘন্টা বেজে গেছে।
সেই ঘটণার পর থেকে শরীরটা আরো কমজোরি হয়ে গেল। তারপর পলাশের মাধ্যমে রবি আর বীরেশ, তোমাদের দুজনের সঙ্গে পরিচয় হল। বাস্তবে যা ঘটে না তাই দেখলাম। তোমরা তিনজন কীভাবে মানুষের মত ভালবেসে ফেলেছ চুপিকে, তাকে বাঁচাতে চাইছ। কিন্তু তোমাদের শক্তি কতটুকু!! শাপলাবনের বাওড় যে আর প্রায় নেই। ওটা বুজিয়ে ইকো ফার্মিং আর তার জন্য রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্সের কাজ শুরু হয়েছে প্রায় বছর চারেক। হয়ত আর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ঐ বাওড় বলে আর কিছু থাকবে না। আমি কি পারতাম ?একা একা! যাহোক করে…এমনকি অনশন করে বাওড়টাকে বাচাতে? বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভেবেছি, দেহে -মনে জোর পাই নি। কী করলাম পৃথিবীর জন্য! একটা আদ্যন্ত স্বার্থপর আমি।জানিনা হয়ত সাধ্য ছিল, একটা নদীকে বাচাতে পারতাম…কিন্ত কিছুই করিনি।
তোমাদের কাছে আমার শেষ অনুরোধ। আমায় চুপির চরে শুইয়ে দিও। আর যেকটাদিন চুপি ধুকতে ধুকতে হাটবে তার পায়ের নীচে থেকে পাপস্খালন করতে চাই। বাড়ির লোক কিছুতেই মানবে না , তাদের মানানোর দায়িত্ব স্বার্থপরের মত তোমাদের দিয়ে গেলাম। ভালো থেকো তোমরা তিনজন।”
চুপি সে সুযোগ দিল না। আমাদেরকে দয়া করে চিঠিটাই মল্লিকদাদুর বাড়ির লোক দিল কিন্তু তার মৃতদেহকে প্রণামটুকুও করতে পারলাম না।
পাঁচ.
মল্লিকদাদুর মৃতদেহ মহকুমা শহরের বৈদ্যুতিক শ্মশানে চলে গেছে দুপুরের দিকে। বিকেল পর্যন্ত মন্ত্রপাঠ আর দোয়াদরুদ চলল। অনেক বিদ্রুপ সহ্য করেও আমরা খেয়াঘাটেই বসে আছি।কত তাড়াতাড়ি চুপি শুকোবে আর কীভাবে তার বাটোয়ারা হবে তা নিয়ে দুপারে বেশ উত্তেজনার খবর উড়ছে। আমরা আর কতক্ষণ বসে থাকব? বললাম—
“ পলাশ, এবার চল।আর তো ঢেউ নেই, কী গুনবি?”
আমার কথার কোনো উত্তর এল না। রবিউল বলল “বীরেশদা, পলাশ কাল চলে যাচ্ছে নবাবহাটে।”
“কাল?”
“কেন?”
“ ওর বাবা ওখানে মশলাপট্টিতে মুটের কাজ করবে ।”
“ তার মানে তোরা আর মাছ ধরবি না নদীর বুকে! আগে ঠিক করে নিয়েছিলি পলাশ? নৌকাটা কী হবে তাহলে?”
এবার বলল পলাশ, “ওটা বিক্রি করে দিয়েছে বাবা।”
“কিন্তু তুই যে চুপিকে ছেড়ে যেতে চাইতিস না? চুপির ঢেউয়ে নৌকা না ভাসালে তুই বাঁচবি?”
“ কী করব? নদীতে আর মাছ নেই, পেট তো চালাতে হবে?”
রবি প্রায় চিৎকার করে উঠল “ তা বলে চুপি থামার আগেই তুই বাবার কথা মেনে নিলি, সেই তুই… যে চুপির জন্য বাবার কোনো কথাই শুনতিস না!”
“ আর তুমি কী করলে রবিভাই…পয়সার জন্য চুপিকে বাজারের মেয়েছেলে বানিয়ে বেচ নি?”
“তোরা থাম…কী উল্টোপাল্টা বলছিস তোরা, কালকেও এই সময়, আর কী কী করে চুপিকে বাঁচানো যায় সেকথা আমরা ভাবিনি?”
“ ভেবেছি…তুমি একা ভেবেছ! আর আমরা কেউ পেটের জন্য চুপিকে ছাড়তে চেয়েছি আরে রবিভাই তুমিও বল, চুপ করে আছ কেন”
থেমে থেমে একটা একটা করে শব্দ উচ্চারণ করল রবিউল“ বীরেশদা… একটা প্রোডিউসার অফার দিয়েছিল, একটা জনপ্রিয় উপন্যাসের অনুকরণে আমাদের চুপির পাড়ের জেলে-মাঝিদের মেয়েদের বেশ্যাবৃত্তি দেখিয়ে স্ক্রিপ্ট লিখেছি… ছবিটা ফেস্টিভ্যালে যাবে তাই দেখিয়েছি চুপি নিজেও একটা বেশ্যা হয়ে উঠবে একসময়…ওই যাদুবাস্তবতা!”
“ প্রায় পাঁচ লাখ পেয়েছ, গ্রামের কারোর জানতে বাকি নেই।”
“ না রে অত না অনেক কম…সব গুজব!”
“ বলেছিলে,তুমি নাকি নতুন করে চিনেছ চুপিকে…তোমার রুহ্ পাক হয়ে যায় চুপির কাছে আসলে”
“ কিন্তু তার জন্য…চুপি থেমে গেল!”
আমি চিৎকার করে উঠলাম—
“ ওরে তোরা থাম, থাম…ওতে কিছু হয় না। এ পাপ আমার, অনেক আগে ঐ বাওড় বিক্রির দালালি করেছি আমি..কোটি কোটি টাকার প্রজেক্ট রে…”
ছয়.
আমি আর পলাশ একসঙ্গে বীরেশদাকে বলেছিলাম –“ কী আছে, কী নেই কিচ্ছু জানি না। আমাদের চুপি মরতে পারে না…একবার চল তিনজনে চুপিকে জড়িয়ে কাঁদি…ফিরে আসতে বলি…”
তারপর আমাদের শরীরের শেষ সুতোটুকু ছুড়ে ফেলে একসঙ্গে তিনজনে চুপিতে মিশে গেলাম। সাঁতার দিয়ে ওর বুকের মাঝখানে গিয়ে তিনজন, তিনজনের গলা জড়িয়ে ধরলাম। ডুব দিয়ে ওর মৃতদেহের গভীরে পোছোব…ঠিক তখনি শুনলাম জলের গর্জন…সামনাসামনি কোনো জলপ্রপাত দেখিনি, আজ ভরা পূর্ণিমার জোছনায় দেখলাম ভাটির দিক থেকে ধেয়ে আসছে পাগলাহাতির মত জলের স্রোত…আমরা তিনজন গোটা শরীর দিয়ে চিৎকার করে উঠলাম…চুপি ফিরে এসেছে…ফিরে এসেছে চুপি…
নাহ…এ্সব কিচ্ছু হয় নি। সেই সন্ধেতে বীরেশদার আর্তনাদ থামলে। খেয়াঘাট থেকে রাস্তায় তিনজনে একসঙ্গেই নেমে এসেছিলাম। তারপর পলাশ চলে গিয়েছিল জেলেপাড়ায়, আমি মুসলমান পাড়ায়। বীরেশদা বাইকে স্টার্ট দিয়েছিল…ওকে চল্লিশ কিলোমিটার ফিরতে হবে…বাঁধের উচু রাস্তার ওপারে পড়েছিল চুপির লাশ।
লেখক : রাজেশ ধর , কলকাতা, ভারত।।