নদীকে কী করে ভালবেসে ফেললাম আমি? কবে থেকে? নিজেকে প্রশ্ন করেছি অনেকবার। নদীর কাছে গিয়েও নিজেকে প্রশ্ন করেছি। আবার কখনও একলা আছি। টুপ করে একটা নদীর ছবি ভেসে উঠলো। কেন? হয়তো একটা শেকড় খুঁজতে চেয়েছি। জানি না।
এখন প্রায়শই একটা ছবি দেখতে পাই। আমার বাবা রাজশাহীর (অধুনা নওগাঁ জেলা) আত্রাইয়ের পারে দাঁড়িয়ে আছে নৌকায় পার হয়ে বাড়িতে আসবে বলে। আমি সত্যিই দেখতে পাই। বাবা শুধু বলেছিল খুব ছোট্টবেলায় এক আনা দিয়ে বাবা আত্রাই নদী পার হতো। সাহেবগঞ্জ। ছোটবেলায় সব কিছু হঠাৎ ছেড়ে চলে আসা। এটুকুই বাবা বলতে পেরেছিল। বুকের ভিতর শুধু এই দুটো শব্দ নিয়েই জীবনে প্রথমবার বাংলাদেশ পাড়ি দিয়েছিলাম। আত্রাই আর সাহেবগঞ্জ। একে আঁকড়ে ধরেই যেন জীবনের গোড়ায় জল সিঞ্চন করবো। বাবার ছেলেবেলা, ছেলেবেলা খেলার মাঠ চিনতে চেয়েই কি আত্রেয়ীকে ভালবেসে ফেললাম। নদীকে। সেখান থেকেই কি মনে হতে থাকলো নদীর দেশ নাই।
সত্যিই তো নদীর বুকে তো কোনো কাঁটাতার দিতে পারেনি কেউ। আমাদের স্কুলের পক্ষ থেকে একটি নাট্য নির্মাণ করেছিলাম । যার নাম ছিল ‘আত্রেয়ীর উপাখ্যান’। যার বিষয় ছিল নদীর কোনো দেশ নাই।
‘নদীর দেশ নাই
নদীর দেশ নাই
কেনো কাঁটাতার …….’
ওখানেই দেখানো হয়েছিল যে এক দেশের ছাত্র-ছাত্রীরা আরেক দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের নদীকে ভালোবাসার চিঠি লিখছে। আর তা ভাসিয়ে দিচ্ছে আত্রেয়ীর জলে। জলে ভেসে ভেসে সেই চিঠি পৌঁছে যাবে বাংলাদেশের বন্ধুদের কাছে। এমন একটা দৃশ্যে গান গাইবে ওরা –
‘নদীর জলে চিঠি চলে
চলে মোদের বন্ধুতা….’
কেন বললাম এই কথাগুলি? কেননা নিজের জীবন থেকে বুঝতে পারি যে কাউকে ভালোবাসলে তবেই পুরোপুরি নিজেকে সমর্পণ করা যায়। নদীর কাছেও তাই। আগেও নদীকে দেখেছি। এখনও নদীকে দেখি। কিন্তু সেই দেখার মধ্যে পার্থক্য আছে এখন অনুভব করি সেটা। বর্তমানের দেখা অনেকটা ভিতর থেকে দেখা। যে দেখা নদীর কষ্টে কান্না আনে। নদীর যন্ত্রণায় বিদ্ধ করে। তাহলে কি নদী কষ্ট পায়? নদীর মন আছে? আলবাত আছে। ২০০৪/০৫ সালে যবে থেকে নদীকে সচেতন ভাবে দেখতে শুরু করেছিলাম তখন শুধুই বাহ্যিক দেখা ছিল যেন। আর এখন অভ্যন্তরের দেখা। হ্যাঁ, নদীর মন আছে। নদী জীবনধারা। সেই জীবনের মধ্যেও জীবন নামক অসংখ্য জীববৈচিত্র্য আছে। তা সে আত্রেয়ী হোক অথবা ইছামতি, যমুনা, তুলসীগঙ্গা কিংবা বুড়িগঙ্গা। দূষণ,দখল,ভাঙনের বিরুদ্ধে সত্যিকারের প্রতিকার সম্ভব যদি আমরা নদীকে ভালোবাসতে পারি।
বাংলাদেশের কুয়াকাটায় অ্যাকশন এইডের একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আমন্ত্রিত ছিলাম। তারও আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জনইতিহাস চর্চা কেন্দ্রের আয়োজনে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে। সেখানে এই কথাগুলোই বলবার চেষ্টা করেছি। ভিতর থেকে যদি নদীকে ভালবাসতে পারি তবেই তো নদীকে নোংরা করা, নদীকে দখল করার প্রবণতা কমবে। নদীর জন্য চিরস্থায়ী পরিকল্পনা হবে। সেটাও হবে ভালোবেসে।
প্রখ্যাত সাহিত্যিক মানিক বন্দোপাধ্যায়– এর ‘নদীর বিদ্রোহ’- তে নদের চাঁদ কে মনে আছে? যে শুধুই নদীকে দেখতো। সে দেখা ছিল ভিতর থেকে দেখা। আমাদেরকেও সেভাবেই দেখতে হবে নদীকে। তাহলেই দেখতে পাবো নদীকে ধরে বাবার ছেলেবেলায় আমরা পৌঁছে যাচ্ছি। একটা ছেলেবেলা। যা আমাদেরও নদী হতে বলছে।
তাই সবার বুকের মধ্যেই একটা নদী থাকুক। যার যার জন্ম যে যে নদীর পারে শহরে অথবা গ্রামে সেই সেই নদী থাকুক তাদের বুকের ভিতর। অথবা অন্য কোনো নদী যার সঙ্গে কোনও স্মৃতি বিজড়িত। হতে পারে যে কারোরই ছেলবেলা অথবা বড়বেলায় কোনো নদীর সংযোগ নেই তবু তাদেরও বুকের ভিতর একটা নদী ভরে নিতে বলবো কেননা আমরা তো সবাই নদীর সন্তান। তাহলেই আমাদের একটা নদী – মনন তৈরি হবে। নদীকে ভালো রাখতে গেলে নদী মনের নৈবেদ্য সবার আগে জরুরী। তা সাধারণ মানুষ হোক বা রাষ্ট্রনায়ক।