মরা নদীর গল্প ।। অনিন্দ্য আাসিফ

আাসিফ

সাপে তার ভয় ছিল না কখনও। এখনও নাই। লেজ ধরে মাথার উপর চড়কির মতো ঘুরিয়ে প্রথমে হঠাৎ শূন্যে ছুঁড়ে মারা, তারপর অদৃশ্য করে দেওয়া ছিল তার বাম হাতের খেলা। সামুদ্রিক জেলেদের মতো। জালে-পড়া বিষাক্ত সাপ খেলাচ্ছলে ছুঁড়ে ফেলে তারা। কখনও কখনও জানেই না, কী ভয়ানক খেলা অনায়াসে খেলে ফেলল।

কিন্তু এটা সাপ না। শুকনো কচুরিপানায় যে শব্দ, সেটা ইঁদুর হতে পারে। উৎকট একটা গন্ধে এবার মনে হয়, এটা আসলে একটা চিকা। বয়স তার দৃষ্টি আর শ্রবণশক্তির কিছুটা হরণ করেছে, কিন্তু অনুপাতে কমই। তার সামনে – অদূরে কাঁচা কচুরিপানা আর নদীর ঠিক মাঝখানে তার ঘরের আয়তনের জায়গায় যে জল, আর জলের উপর ওপারের যে আলো, তা তার চোখে ঝিলিক দেয়। চিকার শব্দ তো বটেই, ওপারে স্টেডিয়ামের ভেতরে মাইকে একটা লোক আঞ্চলিক ভাষায় ছড়া পাঠ করছে, তাও তার কানে ধ্বনিত হয়।

লোকটা গলা ঝাড়ে। আটকে থাকা কফ ছুঁড়ে মারে হঠাৎ শ্যালোর মুখে জমা ধমকা পানির মতো। এটা তার পুরনো অভ্যাস, কায়দা অথবা বদ অভ্যাস। নাক টেনে, কখনও গলা ঝেড়ে ঘন হলুদ তরল জমা করে মুখের ভেতর; তারপর গোল-করা ঠোঁটের কাছে এনে ধমকা বাতাসের মতো একটা ফুঁ; মুখের তরল তখন দৃষ্টিসীমায় জল, বালি, ঘাস অথবা ভুলবশত দেয়ালের গায়ে। বাচ্চারা মজা পায়, বড়দের কেউ হাসে, কেউ ঘিনঘিনিয়ে অন্যপাশে অগত্যাই অন্যকিছু দেখার ভাণ করে।

এটা মূলত ছিল মুদ্রাদোষ। বয়স এবং অনিয়ম সেটাকে এখন অসুখ বানিয়েছে। ইচ্ছা না করলেও এখন কাশতে হয়। ইচ্ছা করলেও সবসময় ফুঁ দিয়ে দলাথুথু দূরে ফেলা যায় না। এমনকি ঠোঁটেই কখনও লেপ্টে পড়ে।

তুলনায় ঠাণ্ডা কম আজ। তরতরিয়ে বাড়ে রাত। যদি বয় হাওয়া – পাল্লা দিয়ে বাড়বে হয়তো শীতও। স্টেডিয়ামে বইমেলা চলছে। লোকটার এই ব্যাপারে কোনও আগ্রহ থাকার কথা না। নাইও। তবে মেলা প্রাঙ্গণে বসেছে সর্বসাধারণের মেলা। প্রাঙ্গণের মধ্যখানে হয় আলোচনা, হয় গান এবং নৃত্য। লোকটা গিয়েছিল গতকাল। একটা ঝনঝনি কিনেছে ছোট মেয়ের ছোট ছেলের জন্য, আর একটা রবারের বল। বাদাম কিনেছিল দশ টাকার। হঠাৎ কী হলো- লোকজনের ধাক্কাধাক্কি লেগে গেলো। ঠোঙার কোণায় পাঁচটা বাদাম অবশিষ্ট ছিল।

বাতাস বোধ হয় বয় একটু। সঙ্গে আসে ঝিম-ধরা একটা গন্ধ – গাঁজার গন্ধ। নাকটা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। ঘাড়ের ফাঁকা জায়গায় একটা শীতল সাপ বয়ে চলে মনে হয়। মধ্যিখানের এক চিলতে জায়গাটুকুতে ঢেউ কি ভাঙে ক’টা? অতোটা দৃষ্টিশক্তি তার নাই। তবে স্মৃতিশক্তি বলে, ঢেউ তো ছিলই এককালে; স্রােতও বৈ কি! স্রােতের সাথে নৌকা একটা-দু’টা – হাটবারে ঝাঁকে ঝাঁকে। স্রােতের অনুকূলে আর প্রতিকূলে উদ্দাম সাঁতার ছিল নিত্য-নৈমিত্তিক।

ওপারের আলোরমেলা থেকে বশির উদ্দিন, সায়েম আলী; উকিলপাড়া থেকে আব্দুল লতিফ, আব্দুল মতিন; সরকারী কোয়ার্টার থেকে জেল দারোগার ছেলে প্রিন্স। এপারে সে ছাড়া ছিল আরও অনেক উদ্দাম সাঁতারু। ছিল প্রতিবেশী, বন্ধু, হোস্টেলে থাকা কলেজের ছাত্র। প্রায় প্রত্যেকে ছিল ভালো ফুটবলার। কলেজের মাঠে হতো জমজমাট ফুটবল খেলা। খেলা শেষে কি শীত অথবা গ্রীষ্ম – দুরন্ত গোসল আর সাঁতার। কেউ আছে এখনও তার মতো ন্যূব্জ হয়ে, দেখা হয় কালে-ভদ্রে; বেশিরভাগই হয়তো নাই, কোথাও নাই।

মোটা পায়জামার নিচে ডান হাঁটুটা টনটন করে। মাঝে মাঝেই উজিয়ে ওঠে বাতের ব্যথা। ছোট ছেলের নাইনে পড়া ছেলেটা খুব রসিক আর ডানপিঠে। ঠিক তার তরুণকালের মতো। সে বলে, দাদা আসো, একটা কারেন্টের শক দেই। লোকটা হাসে। থেরাপি মন্দ না। ব্যথাটা কমে খানিকক্ষণের জন্য। বাসায় থাকলে এখন বলা যেতো, রনি, আমারে একটা কারেন্টের শক দে। কিন্তু বাসাটা এখন দোযখের টুকরা। ছোট ছেলের বউটা সারাক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করে। নিজের বউটা কী এক রোগে মারা গেল বছর পাঁচেক আগে; ডাক্তার রোগই ধরতে পারলো না। বলা ভালো, অর্থাভাবে ভালো ডাক্তারই দেখানো যায়নি।

ভালো তবু – রিক্সাচালক বড় ছেলে বউ-বাচ্চা নিয়ে সিলেটে থাকে। একটা লুঙ্গি, কখনও একটা পাঞ্জাবী নিয়ে আসে বছরে এক কি দুইবার। যাওয়ার বেলায় হাজার খানেক টাকা দিয়ে পিতৃভক্তি দেখায়। কপালের ফের- তার বউটাও ছোটটার মতো খিটখিটে স্বভাবের। দোযখের উত্তাপ আর ঘনবসতির যন্ত্রণা থেকে তাদের দূরে অবস্থান মঙ্গলজনক। বরং ঢের ভালো স্বামীসহ তার মেয়ে দুটো। একজন খুব কাছেই- নগুয়ার প্রথম মোড়ে। অন্যজন শহরের উত্তর প্রান্তে- কানিকাটা পানির ট্যাংকের নিচে। সপ্তাহে বার দুয়েক আসে তারা। বাপের দেখভালে নজর সন্তোষজনক।

ডান কানের নিচে সুরসুরি শুরু হয়। শীতকালের সুবিধা- এলার্জির যন্ত্রণা তেমন পোহাতে হয় না। এই সুরসুরি এলার্জির জন্য না। কিছু একটা ঢুকল কি? মাফলারের নিচ দিয়ে তর্জনী ঢোকালে মনে পড়ে, এটা ছোটবেলায় কেটে যাওয়া দাগ। বিচ্চুর মতো বাঁকা হয়ে ফুলে আছে। স্পষ্ট মনে পড়ে তার; মেলার একপাশে তার পিতা আব্দুল আলী বাহারি পোশাক পরে, বাম হাতে ঝনঝনি বাজিয়ে আর ডান হাতে রিল ঘুরিয়ে সুর তুলছে-

কী সুন্দর দেখা গেলো

মক্কা-মদিনা আইসা গেলো,

তারপরেতে দেখতে ভালো

যমুনার জল দেখতে কালো,

আরও সুন্দর দেখতে আছে

ঢাকা শহর আইসা গ্যাছে…

অন্যপাশে গুজব উঠল, সার্কাসের হাতি ছুটে বের হয়ে যাচ্ছে। সার্কাসের সামনে থাকা সেও অন্যদের সাথে দিল দৌড়। সামলাতে না পেরে পড়ল শুকনো-ভাঙা শামুকের উপর। কেটে যাওয়া জায়গাটা শুকালো দিন কয়েকের মধ্যেই। কিন্তু, অদ্ভুত- জীবনের শুরুতে শুরু সুরসুরিটা শেষ বেলাতেও থেকে গেলো। তবে এই ভালো – সুরসুরি শুরু হলেই বাপের কথা মনে পড়ে। বায়োস্কোপ দেখাতেন তিনি। কী সুন্দর সুর করে লোক জমায়েত করতেন। যেনো শান্ত নদীর ঢেউ। কাছে-ধারে কোনও মেলা হলে সঙ্গে যেতো সে। দূরে হলে কোনও কোনও দিন তিনি বাড়ি ফিরতেন না।

গরমের সময় দিন অথবা রাত, এসেই কাঁধে গামছা-লুঙ্গি নিয়ে নদীর ঘাটে এসে আরাম করে গোসল সারতেন। বর্শিতে মাছ ধরার নেশা ছিল তাঁর। রাতের বেলায় পাড়ে বসে বর্শিতে আধার গেঁথে ছুঁড়ে মারতেন মাঝ নদীতে; তারপর ঘন্টার পর ঘন্টা বর্শিতে টান পড়ার অপেক্ষা। কোনওদিন দুইটা, কোনওদিন একটাও না। কিন্তু বোয়াল মাছের জন্য অপেক্ষাটা তিনি উপভোগ করতেন। একদিন কী হলো- মাছ নিয়ে বাড়ি ফিরলেন, মাঝরাতে রান্না করিয়ে সবাইকে নিয়ে খেয়ে-দেয়ে ঘুমালেন, কিন্তু সকালে আর জাগলেন না।

সে বায়োস্কোপ নিয়ে বেরুতে চাইলো। কিন্তু তার মা দিলেন না। ওসমান ওস্তাগরের সাথে গেলো কিছুদিন। মাথায় ইট-সুড়কি বইলো; কিন্তু হাতে পায়ে সিমেন্টের এলার্জি। কিছুদিন গোপাল কর্মকারের কামারশালায় হাপর টানলো; আগুনের ফুলকি পড়লো ডান চোখের পাতায়। তারপর থেকে গাওয়ালে – চুড়ি, ফিতা, মাটির সাবান ইত্যকার বস্তু বিক্রেতা।

মাকে মনে পড়ে। কী এক জেদ নাকি আবেগে কাউকেই তিনি বায়োস্কোপ ছুঁতে দিতেন না। সে লক্ষ্য করেছে – তিনি আড়ালে, অগোচরে কাঁচের মুখে চোখ রেখে ভেতরে তাকিয়ে থাকতেন; তারপর চোখ নামিয়ে আঁচলে অশ্রু মুছতেন। মৃত্যুমুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর চৌকির এক কোণে বায়োস্কোপটা রাখা ছিল। কিন্তু তাঁর নিষেধ অমান্য করে সে নদীতে মাছ ধরতো, এমনকি নদীটা অর্ধমৃত হওয়া পর্যন্ত এই নেশাটা ধরে রেখেছিল সে।

টান হয়ে বসতে চাইলে মেরুদন্ডটা মড়মড় করে ওঠে যেনো। শুকনো ডাল ভাঙার চেয়ে তফাৎ খুব সামান্যই শব্দটা। স্টেডিয়ামের ভেতর থেকে কোনও শব্দ আসে না আর। লোকজন বেরিয়ে এসে ফাঁকা করে দিচ্ছে স্টেডিয়ামটা। এখান থেকে তার পক্ষে বোঝার উপায় নাই। শুধু নিরবতা উপলব্ধি করা যায়। একটা শব্দ হয় অবশ্য; কাছেই – তার পেছনে, মানুষের ফিসফিসানির মতো। টর্চটা ভুল করে ফেলে এসেছে – উঁচু জায়গা থেকে নামতেই মনে পড়ল তার। কিন্তু আর ফেরত যায়নি। পা টিপে টিপে এখানে এসে বসলো সে। এইখানে – মানে, যেখানে দিনের বেলায় তার-করা গোলমত পরিষ্কার জায়গাটা- যেখানে অন্ধকার জমাট বাঁধা- সে এসে বসল।

উচ্চস্বরে গলা ঝাড়ে সে। ঘন দলাথুথু ছুঁড়ে ফেলতে প্রয়াসী হয়। খানিকটা বের হয়, বাকিটুকু লেপ্টে পড়ে ঠোঁট আর থুতনিতে। সোয়েটারের বাম হাতল দিয়ে মুছতে গিয়ে টের পায়, ফিসফিসানিটা নাই। বামে তাকায়- খানিক দূরে, কলেজ অফিসের মাথায় একটা বড় বাতি বেলের মতো ঝুলে। তার সময়ের একতলা কলেজে এখন অগুণতি বড় বড় দালান। গোনে সে- পশ্চিমে দুইটা ছয়তলা, উত্তরে পাঁচতলা তিনটা, দক্ষিণে মেয়েদের হোস্টেলে চারতলা তিনটা, পশ্চিমে ছয়তলা দুইটা, উত্তরে পাঁচতলা… গুলিয়ে ফেলে সে।

পুনরায় গুনতে গেলে অফিসের মাথার বাতিটা দপ করে নিভে যায়- সঙ্গে চারিদিকের সকল আলো। এই ভালো- অন্ধকারের সৌন্দর্য। তার ছোটবেলার শহর। শহর মানে মহকুমা শহর। এখানে জঙ্গল, ওখানে জঙ্গল। সন্ধ্যা হলেই ভূতের ভয় কারোর। অনেকেরই বিদ্যুতের ধারণা পর্যন্ত নাই। কেবল কেউ কেউ জেনে, না-জেনে নিজের ছেলের নাম রাখে বিদ্যুৎ। মহকুমার মোড়ে মোড়ে পৌরসভা কর্তৃক একটা করে বড় বাতি তখন। লোকে বলতো, গাছবাত্তি।

একটু দাঁড়ানো দরকার। কিন্তু একসাথে দু’পায়েই ঝিনঝিন শুরু হয়। লেপ্টে বসে হাত-পা লম্বা করে নড়াচড়ার চেষ্টা করে সে। হাতড়ে একটা কাঠি খুঁজে পায়। ডান কানের ফাঁকে গুঁজে দেয় সেটা। শুকনো কচুরিপানায় নতুন করে শব্দ শুরু হয়। তবে কাঁচা কচুরিপানার ভেতরের শব্দ তার খুব প্রিয়। ওখানে মাছের সম্ভাবনাই বেশি। লম্বা-মোটা ছিপের মাথায় বড় বর্শি দিয়ে কতো শোল আর গজার মাছ শিকার করেছে তার বর্ণনা করলে একালের তরুণরা বিস্মিত হয়। বর্শিতে জ্যান্ত ছোট মাছ লম্বা ছিপ দিয়ে দূর থেকে কচুরিপানার ফাঁকে ধরে রাখলে শোল, কখনও গজার ছোট মাছটা গিলে নিলেই ছিপে টান লাগতো আর তখনই সজোরে তুলে আনতো বর্শির সঙ্গে মাছটা।

একটা দীর্ঘশ্বাস টানে সে – নদীর জন্য মায়া বা আফসোস। চোখের সামনে কীভাবে ঝিমিয়ে পড়লো নদীটা। সঙ্গে সঙ্গে দখল হয়ে যেতে থাকলো কি গ্রাম এমনকি শহরেও। পাড় ধরে জমিচাষ আর দালান উঠতে থাকলো। বোয়াল, শোল, গজার, চিতল প্রভৃতি মুখ ফিরিয়ে নিলো। পাড় ঘেঁষে থাকা ঝাঁকে ঝাঁকে – কৈ, শিং, মাগুর ইত্যাদি গেলো হারিয়ে। আর গাঙচিল? গাঙ থাকলে তো গাঙচিল! দু-একটা শুশুক, এই সিজনে দল-বাঁধা অতিথি পাখি – নাই, কিছুই নাই। অবশ্য শেষাব্দি ভরা বর্ষায় জলটুকু ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রের মাথায় কী এক চিন্তা ঢুকল- লোকে বলে, চিন্তাটা ভালো ছিল; কিন্তু ভালো হলো কই?

বছর খানেক আগে, আন্তঃথানা ফুটবল প্রতিযোগিতার একটা খেলা দেখতে স্টেডিয়ামে গেলো রনিকে নিয়ে। গোলবারের খুব কাছে বসলো; এটাই অভ্যাস তার। খুব কাছে থেকে গোল দেখার আনন্দানুভূতি। পেনাল্টি কিক। সজোরে কিক দেওয়া বলটা বারের ভেতরে না গিয়ে গেলো তার কান ঘেঁষে। মনে হলে কানটা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। ফেরার পথে হঠাৎ নদীর পাড়ে একটা বিলবোর্ডে তার চোখ আটকে গেলো। খুব সুন্দর- কৃষ্ণচূড়ার ভেতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে একটা নদী। দুইধার ইট দিয়ে বাঁধানো। নাতিকে জিজ্ঞেস করলো, রনি, এইটা কী রে?

দাদা, এই নদী লেক হইবো। এইটা লেকের নকশা।

না বুঝেই বিস্মিত হয় সে। বলে, লেক কী?

রনির মাথায় কুটিল বুদ্ধি খেলে। বলে, দাদা, লেক মানে হ্রদ, হ্রদ।

তার ভ্যাবাচ্যাকা চেহারা দেখে রনি হাসে। তারপর বুঝিয়ে বলে। সে বোঝে কি বোঝে না, কিন্তু আফসোসের ভেতর খুশি হয়। মাছ না থাকুক, পানি বইবে; স্রােত না থাকুক, নৌকা চলবে; পাড়জুড়ে সুন্দর সুন্দর গাছ থাকবে; বসার জন্য সিমেন্টের টুল থাকবে; রাতের অন্ধকারেও আলো থাকবে; আরও কতো কী!

কতোকিছুই হলো; কিন্তু যেনো ঠিকঠাক কিছুই না। তার বাড়ির পরিবেশের সাথে মিলে যায়। প্রতিবেশিরা ক্রমে তুলনায় বেশি দামে বাড়ি বিক্রি করে গ্রামের দিকে চলে গেলো। অপরিচিত লোকেরা এসে দালান তুলে তার ভেতর বন্দী পাখির মতো আটকে থাকে। মেয়েছেলে ছাড়াও পুরুষগুলোও কাজ ছাড়া উঁকি দেয় না। ফলে তারা পরিচিত হয়, কিন্তু ঠিক প্রতিবেশি হয় না। সে রমিজের দোকানে তুলনায় বেশি যেতে থাকে। ওখানে চেনামুখের সাথে দেখা হয়, হয় হাসি-ঠাট্টাও। উচ্ছেদ অভিযানে রমিজ উধাও হলে সেই উপায় আর থাকে না।

এখানেও এমন – পাকা ঘাট, পাকা সব বসার জায়গা, এমনকি হাঁটারও; অগুণতি সব লোকজন আসে, যায়; কিন্তু তার সাথে মিল নাই – কি পোশাকে, কি চেনা-পরিচয়ে।

ওয়াচ টাওয়ার।ছবি- মো: হা‌কিমুজ্জামান ওয়া‌জেদ
এই যে এখানে, ওয়াচ টাওয়ারের উত্তরে, একেবারে লেকের পাড়ঘেঁষা- সময় পেলেই সে এসে বসে; বসে থেকেই ফেলে আসা কতো সময় আর জায়গা ঘুরে আসে; বউয়ের সাথে খুনসুটি করে, গাওয়ালে ‘লেইস ফিতা’ বলে চেঁচায়, কচুরিপানার নিচে শোল আর গজার মাছের শব্দ শোনে, নদীজুড়ে বর্শি-পড়া বোয়ালের দৌড় দেখে। বিকেল হলে জায়গাটা দখল হয়ে যায়। তখন লেকের পাড় ধরে পশ্চিমে, আবার পূর্বে ঝুঁকে ঝুঁকে হাঁটে। পথরোধ করে অবৈধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা একটা বহুতল ভবন। অগত্যা উল্টোপথ ধরে সে। লেকের মাঝখানে কে একজন মাচাঙ পেতে সবজি চাষে মশগুল হয়েছে। হাসি পায় তার। দেখে, এখানে রূপান্তরিত নদীর প্রস্থ কিশোরবেলার লম্ফখেলার দুই লাফের দূরত্ব। আবার হাঁটে। এবার দুর্গন্ধে বমি আসে তার।

তার ঠিক পিছনে- ওয়াচ টাওয়ারের নিচে, অন্ধকার থেকে ফিসফিসানিটা আবার আসে। নারীকণ্ঠ জড়িয়ে আছে এবার, অথবা আগে থেকেই ছিল। ভুল ভাঙে তার, ফিসফিসানি ছাপিয়ে এটা আসলে শীৎকার। অদ্ভুত অনুভূতি হয় তখন। ভারাক্রান্তও। প্রশ্ন জাগে – বৃদ্ধ মানে কি অথর্ব? এই মানুষগুলো কি মৃত? এই যে একটা মানুষ, বসে আছে অনেক্ষণ, কেশে যাচ্ছে, গলা ঝাড়ছে ক্রমাগত, অথচ নির্দ্বিধায় তার ঠিক পিছনে এমন কাজ চলতে পারে? নিশ্চয়ই তারা তাকে মৃতের সাথে তুলনা করেছে।

গলাটা ভারি হয়ে আসে। খুব জোরে ঝাড়তে ইচ্ছে করে। কিন্তু সে নিঃশব্দ ছায়া হয়ে যায়। একটা ছায়া- যেনো ঘাড়ভাঙা ঘোড়া- ধীরে উঠে দাঁড়ায়। উপরে ওঠার জায়গাটা এমন – ওয়াচ টাওয়ার ঘেঁষেই উঠতে হয়। সন্তর্পণে ঘোড়াটা যেনো একটা পাহাড় বেয়ে উঠতে থাকে। কাতরানো অথবা সঙ্গমের শব্দ শোনে সে- মানুষ অথবা একটা হারানো নদীর।

অনিন্দ্য আাসিফ : গল্পকার।


আরও পড়তে পারেন…..
কালনির স্নিগ্ধতায় আমার ছেলেবেলা ।। আলম মাহবুব
নদীর নাম মুজনাই ।। শৌভিক রায়
“নদী সেতু হয়ে আছে আমাদের বন্ধুত্বে” 

সংশ্লিষ্ট বিষয়