প্রিয় নদী ।। মনোনীতা চক্রবর্তী

প্রিয় নদী

জল উঁচু-নীচু হলে বড়ো মায়া পড়ে যায়। জল যখন খেয়ালে গান গায় এবং গাইতে-গাইতে যখন হঠাৎ তার ভয়েস-চোকড হয়ে যায়; যখন কান্নাগুলো পোশাক পরতে গিয়ে আসলে পোশাক খুলে ফেলে; দৃষ্টিলক্ষ্য যখন ভেঙে টুকরো-টুকরো হয়ে যায়, যখন লাজুক চাঁদের ধারালো চোখের ছায়া জলের ওপর পরে, যখন একটা উত্থিত দুপুর বিকেলের যৌথ-গান হয়ে ঝরে পড়ে আর চরাচর মুখর হয় সভ্যতা-গানে.. ঠিক তখন পরিকল্পনাহীন ছুটে যাই প্রিয় নদীটির কাছে।

হ্যাঁ, খেয়ালে-আড়ালে; অভাবে-অভিমানে ধুমধাম প্রেমে ভিজলে শ্বাসের ওঠা-নামা যেমন করে হয়, ঠিক সেভাবেই আমি ছুটে যাই তার কাছে। প্রিয় নদীটির কাছে। ডক নদী; সে-নদীটির নাম। আমার ঘরের পাশেই প্রায়। বলদিহাটার ওপর দিয়ে ডকের যে-শরীর ডানা মেলে ছুটে গিয়েছে, তার কাছে। উৎসবে-একাকিত্বে কখন যাইনি তার কাছে! বিজ্ঞাপনের পাতা-জুড়ে যখন হুবহু সত্যের মতো পিপাসা, তখন সেই আগুনে দু-হাতে তুলে পান করি প্রিয়তম জল। জল ও আগুনের সহবাস লিখি আই-প্যাডের কি-বোর্ডে। যে-আমার সমস্ত লুকোচুরির একমাত্র সাক্ষী। সবটুকু তার জানা।

আমার মান্না দে-র ওই গানটির কথা খুব মনে পড়ছে। ওই যে, ‘নদী এমন নদী জল চাও একটু যদি দু-হাত ভ’রে উষ্ণ-বালু দেয় আমাকে…‘ গানটি ভীষণভাবে মিলে যায় আমার সাথে, এমন বলবো না। শুধু ‘উষ্ণতা’ টুকু অদ্ভুতভাবে মেলে! কিন্তু এই বালি আমাকে পোড়ায় না। বরং উলটোটাই।

ছোটো থেকে পড়া ভূগোল আমার কোনোদিনই স্কোর-শিট উজ্জ্বল করেনি, তাই আমি প্রকৃতিকে হৃদয়েই রেখেছি; কখনও ভূগোলে রাখিনি মোটেও! আর নদী? একেবারেই নয়। তার প্রতি, আমি বরাবরই পক্ষপাত দোষে দুষ্ট ভীষণভাবে! তাই, শুধুমাত্র নদীটির নামই রাখলাম। কারণে-অকারণে একা অথবা অনেকে অথবা পারিবারিকভাবে ছুটে যাওয়া সুযোগ পেলেই! যখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা-দিবসে প্রিয়তম মুখেদের সঙ্গে নৌকোয় মাঝনদীতে হঠাৎ ধেয়ে আসা ঝড়ের দোলায় দোলনার মতো দুলছিলাম আর গেয়ে উঠছিলাম, ‘বাংলা আমার তৃষ্ণার জল, তৃপ্ত শেষ চুমুক; আমি একবার দেখি বারবার দেখি দেখি বাংলার মুখ..’

আমার ডান হাত তখনও আনমনে জলের বুকে আঁচড় কেটেই চলে ছিল! পরে নিজেও বিশ্বাস করতে পারিনি। কিন্তু, পুরো রোববারের সাহিত্য আড্ডা-র সব্বাই তার সাক্ষী! অথচ, তখন ভয়ে সিঁটিয়ে থাকারই কথা আমার অমন দুর্যোগে। হ্যাঁ, আজও বিশ্বাস করতেই চাই যে যার টানে আমি সেখানে বারবার ছুটে যাই; সে-ই আমাকে শক্তি দিয়েছিল…আমার প্রিয়তম জল; আমার আদরের নদীটি। অনেক-অনেক দেনা ও সঞ্চয় তো তারই কাছে আমার। সবটুকু তো লেখা যায় না। কথাও নয়। দু-একটি তার থেকেই বলা…

একবার, ২০১৩-তে আমাদের ‘দাগ’-এর উৎসব সংখ্যার প্রকাশ হল। প্রকাশ করলেন আমার অত্যন্ত প্রিয় কবি শ্রদ্ধেয় প্রবীর শীল এবং শ্রদ্ধেয় কবি-সম্পাদক খুব প্রিয় কাকু নিশিকান্ত সিনহা মহাশয়। হ্যাঁ, এই নদীটির প্রিয়তম বুকেই মাথায় রেখেই। সেদিন ছিল মহাষষ্ঠী। আর তখনও সাথে ছিল আমাদের রোববারের সাহিত্য আড্ডার পুরো টিমসহ শিলিগুড়ি শহরসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা সাহিত্য-প্রিয় একঝাঁক গুণী মানুষ। সঙ্গীত-শিল্পী এবং বনবিভাগের আধিকারিক অরুণাচল বসুর গান আজও কানে লেগে আছে।

সুজাতা’দির কবিতা, ছোট্ট রুঙসিতের সিনথেসাইজারের সুদীপ’দার গল্প, অশেষ’দার নদীর কত কথা, সঙ্গীতার নদীর পাড়ে হেঁটে বেড়ানো, বিবেক’দার প্রাণখোলা কবিতা এবং ‘এবং’-এর ভিতর আর যা-যা থাকে সবটুকু নিয়েই এই হৃদয়ের আড্ডা! মাথার ওপর সুনীল আকাশ, সামনে যতদূর চোখ যায় সবুজ আর সবুজ..বিস্তৃত চা-বাগান আর পাশে ও পেছনে এবং সামনে অন্তহীন জল আর জলোচ্ছাসের তুমুল শব্দ। ওপাশে হাট। খেয়া-পারাপার; মাঝিভাইদের সে কী উজ্জ্বল মুখ যখন তাঁদের ছবি তুলছিলেন শিবশঙ্কর! সুশান্ত’দা তখনও গেঁথে যাচ্ছিলেন কথামালা! সুদীপ্তর লেন্সে রাখা উজ্জ্বল চোখ, শুভাশিস’দার গান, ডক্টর বিনয়ভূষণ বেরার গান, কলকাতা থেকে ছুটে আসা শঙ্কর বাবু, বাসুদেব’দা,ভবেশ’দা রাজু, শিপ্রা’দি, উৎসব, প্রসূন’দা, অভিজিৎ’দা, চন্দন যে-যার ভূমিকায়। তপন’দা মন দিয়ে সামলে নিচ্ছিলেন রান্নার দিকটি। সব তো এই নদীকে ঘিরেই!

আমার কবি সুবীর সরকারের লেখা ‘অঞ্চলগাথা’ মনে পড়ে। আমার প্রিয় কবি ভাই সুমন মল্লিক-কে মনে পড়ে। পাড় আর মনের ভিতরে গভীর বুনোট আমাকে নিঃস্ব করে তোলে প্রবল! আমি তাকে ছুঁয়ে থাকি, কেবল ছুঁয়ে থাকি…জলের কাছে আমার অনেক-অনেক ঋণ! আজীবনের ঋণ! কথায় তাকে ধরি কী-করে! নদী পেরোনোর সূর্য-ওঠা একলা ভোর; সূর্য- নেভা তার বাঁশি, কাচে কেটে যাওয়া পায়ের পাতা ও রক্ত; পাথরের গায়ে রাতজাগা আড়ালের হিরেবিন্দু-নাকছাবি…কত-কত কী!

একবার আর-একটা ঘটনার কথা বলি, আমার আর-একটি পত্রিকা যেটা আমার মা, আমার মেয়ে এবং আমার গড়া- ‘শেষের৪৮পাতা থেকে’, তারও প্রথম-প্রকাশ হয় নদীর বুকেই।সরাসরি এক কোমর জলে নেমেই! এ এক বিরল মুহূর্ত! শব্দে বাঁধা কিছুতেই সম্ভব নয়! আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ-র ‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি’-কবিতাটির কথা খুব মনে পড়ছে! সারিসারি পঙক্তি সাঁতরে যাচ্ছে কেবল চোখের সামনে…

আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
তাঁর করতলে পলিমাটির সৌরভ ছিল
তাঁর পিঠে রক্তজবার মত ক্ষত ছিল।”

বাবার নাভিকুণ্ড আর আমার তীব্র জখম যখন সবার আড়ালে অন্ধ-রাতে জলের বুকের ভিতর আমি রোপণ করলাম; এই আমি সেদিন থেকে আরও-আরও ঋণী রইলাম জলের কাছে… নদীর কাছে…

আমি আমার মায়ের কথা বলছি,
তিনি বলতেন প্রবহমান নদী
যে সাঁতার জানে না তাকেও ভাসিয়ে রাখে।”

মনোনীতা চক্রবর্তী : শিক্ষক, সম্পাদক, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।


আরও পড়তে পারেন……
টাঙ্গন : আমার প্রিয় নদী ।। ড. অমর কুমার পাল
যে নদীকে কেবল ভাসিয়ে দেওয়া গেল ।। সুপ্রতিম কর্মকার
নদীর নাম বলাকুট ।। মনির হোসেন
আড়িয়াল খাঁ নদ- স্মৃতি ও বাস্তবতায় ।। হাসান মাহবুব

সংশ্লিষ্ট বিষয়