ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলা নারায়ণগঞ্জ। জেলায় প্রবাহিত দুই নদী একটি শীতলক্ষ্যা ও আরেকটি বালু নদী। কিন্তু নানা কারণে দূষণ হচ্ছে দুই নদী। বিভিন্ন শিল্প-কারখানা থেকে আসা ১৫ কোটি লিটার বর্জ্য মিশছে এই নদীতে। শুধু তাই নয়, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর পানি বিবর্ণ হয়ে পড়েছে। কুচকুচে কালো আর উৎকট দুর্গন্ধে পানি ব্যবহার তো দূরের কথা, শীতলক্ষ্যা নদী দিয়ে চলাচল দুরূহ হয়ে উঠেছে।
নারায়ণগঞ্জের চর সৈয়দপুর থেকে নরসিংদীর পলাশ পর্যন্ত ও চনপাড়া থেকে ভোলানাথপুর পর্যন্ত কমপক্ষে শতাধিক নালা, ড্রেন ও খাল দিয়ে বিভিন্ন শিল্প-কলকারখানার বর্জ্যমিশ্রিত পানি এসে মিশছে শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীতে। নারায়ণগঞ্জ জেলার পাগলা, নয়ামাটি, সিদ্ধিরগঞ্জের গোদনাইল, শিমরাইল, আরামবাগ, ডেমরা, কোনাপাড়া, রূপগঞ্জ, তারাবো, মুড়াপাড়া, রূপসী, যাত্রামুড়া, দীঘিবরাব, গোলাকান্দাইল, বরপা, আড়িয়াব, তেতলাব, আদমজী, কাঁচপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় পাঁচ হাজারের বেশি শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত ডাইং বর্জ্য, কেমিক্যাল বর্জ্য, শিল্পবর্জ্যসহ পলিথিন, পয়োনিষ্কাশন বর্জ্যসহ নানা রকমের বর্জ্য মিশ্রিত পানি ও ময়লা-আবর্জনা বিভিন্ন খাল-বিল, ক্যানেল ও ড্রেনের মধ্যে ছেড়ে দিচ্ছে। এসব বর্জ্য মিশ্রিত পানি গড়িয়ে এসে কোনো রকম পরিশোধন ছাড়াই সরাসরি মিশছে শীতলক্ষ্যা নদীতে ও বালু নদীতে। যার কারণে নারায়ণগঞ্জের সব খাল-বিল ও নালার পানি দূষিত হয়ে পড়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী প্রতিদিন শুধু অপরিশোধিত ১৫ কোটি লিটার ইন্ডাস্ট্রিয়াল বর্জ্য বিভিন্ন খাল-বিল দিয়ে শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীতে এসে পড়ছে। এ ছাড়া সিটি করপোরেশনের পয়োনিষ্কাশন ও গৃহস্থালি বর্জ্য, পলিথিন, বাজারের উচ্ছিষ্ট অংশ, হোটেল-রেস্তোরাঁর বর্জ্যসহ আরো কয়েক কোটি লিটার বর্জ্য এসে মিলছে শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীতে।
সূত্রটি আরো জানায়, শীতলক্ষ্যা নদীতে (ডিও মেনাস ডিজলভ অক্সিজেন) পরিমাণ থাকার কথা চার থেকে ছয় মিলিগ্রাম প্রতি লিটার। কিন্তু বর্তমানে শীতলক্ষ্যার পানিতে আছে মাত্র এক থেকে দুই মিলিগ্রাম প্রতি লিটার। নদীর পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা বেশি মাত্রায় কমে যাওয়ায় নদীতে জলজপ্রাণী বা মাছ টিকতে পারছে না।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (পবা) নারায়ণগঞ্জ শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট এ বি সিদ্দিক জানান, ‘পরিবেশ দূষণকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নামমাত্র জরিমানা করেই দায়িত্ব শেষ করেছে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। কিন্তু তারা পরিবেশ দূষণ সম্পর্কে কঠোর কোনো ব্যবস্থা নেয় না। বছরের পর বছর নোটিশ দেওয়ার পর যেসব প্রতিষ্ঠান এখনো ইটিপি প্ল্যান্ট নির্মাণ করেনি তাদের কারখানা বন্ধ ও সিলগালা করেনি। তাদের একটি গদবাঁধা বক্তব্য, লোকবলের অভাবে তারা মনিটরিং করতে পারছে না। তারা কার্যকর ব্যবস্থা নিলে বিদ্যমান আইনেই পরিবেশ দূষণ রোধ করা সম্ভব।’
সোনারগাঁ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সভাপতি মনিরুজ্জামান মনির জানান, ‘বর্ষা মৌসুমে জোয়ারের পানিতে প্রচণ্ড স্রোতের কারণে দূষিত ও বর্জ্য মিশ্রিত পানি সরে গিয়ে নদীর পানি কিছুটা স্বচ্ছ আকার ধারণ করে। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে নদীতে স্রোত কমে যায় এবং শিল্প-কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য এসে মিশে পানি দূষিত হয়ে উৎকট দুর্গন্ধের সৃষ্টি হয়। উৎকট দুর্গন্ধের কারণে শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর শীতল জলের কাছে দাঁড়িয়ে থাকাই দুরূহ হয়ে পড়ে। নাকে রুমাল চেপে ধরে খেয়া পারাপার হতে হয় যাত্রীসাধারণকে।’
শীতলক্ষ্যা নদী পার হয়ে প্রতিদিন নারায়ণগঞ্জ শহরে আসেন বন্দরের একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা ফয়সাল রহমান। তিনি বলেন, ‘শীতলক্ষ্যা নদীর পানি এতটাই বিষাক্ত ও দুর্গন্ধ যে নাকে রুমাল চেপে নদী পারাপার হতে হয়। নদীর পানি যতই কমছে ততই বাড়ছে দূষণের মাত্রা। এ পানি দিয়ে গোসল তো দূরের কথা, পানি হাতে লাগলে কিংবা শরীরের কোনো অংশে লাগলে চুলকানিসহ নানা রোগবালাই হচ্ছে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ঢাকা বিভাগের রোগ নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ডা. তানভীন আহমেদ চৌধুরী জানান, ‘শিল্প-কারখানার কেমিক্যাল মিশ্রিত বর্জ্য মিশ্রিত পানি খাল ও নদীতে মিশে পরিবেশের মারাত্মক দূষণ হচ্ছে। এই দূষিত পানি ব্যবহারের কারণে শরীরে খোস-পাচড়াসহ নানা রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। তবে দীর্ঘমেয়াদে এই পানি ব্যবহার করলে শরীরে ক্যান্সারসহ নানা ধরনের বড় রোগ হতে পারে।’
পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী শুধু নারায়ণগঞ্জ অংশে তরল বর্জ্য নির্গমনকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে ৩১৮টি। প্রতিটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানেই পরিশোধন প্রকল্প ইটিপি প্ল্যান্ট রয়েছে। কিন্তু তার পরও দিনদিন পানির রং কালচে থেকে কালচে হচ্ছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, বেশির ভাগ শিল্পপ্রতিষ্ঠান খরচের কারণে ইটিপি চালায় না। রাতের আঁধারে এসব কেমিক্যাল বর্জ্য মিশ্রিত পানি ছেড়ে দেয় খাল-বিলে।
নারায়ণগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. নয়ন মিয়া জানান, ‘নারায়ণগঞ্জে তরল বর্জ্য নির্গমনকারী ৩১৮টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ইটিপি প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু তারা রাতের বেলায় অপরিশোধিত পানি সরাসরি নদী বা খালে ছেড়ে দেয়। জনবল সংকটের কারণে তাদের মনিটরিং করা যাচ্ছে না।’ তিনি আরো বলেন, ‘এসব কারখানা মনিটরিং করতে পরিবেশ অধিদপ্তর অনলাইন মনিটরিং সিস্টেম ব্যবস্থা চালু করতে যাচ্ছে। ইটিপি স্লো মিজাইনিং ডিভাইসে সফটওয়ার বিষয়ে রেকর্ড রাখা হবে। এ ছাড়া ইটিপিতে আলাদা বিদ্যুতের সাব মিটার স্থাপন করা হবে। আগামী এক বছরের মধ্যে যাদের ইটিপি আছে কিন্তু চালায় না তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারব। এতে নদী দূষণের মাত্রা কমে আসবে।’
শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানির দূষণ বেড়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করে জেলা প্রশাসক বাব্বি মিয়া বলেন, ‘শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীসহ নদী দূষণের জন্য দায়ী কারণগুলো চিহ্নিত করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হবে। যাতে মন্ত্রণালয় বিষয়টি নতুন এজেন্ডায় অন্তর্ভুক্ত করে জনস্বার্থে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে।’