মো.ইউসুফ আলী>> বুড়িগঙ্গা একটি নদী। একটি জীবন্ত ইতিহাস। একটি দেশের রাজধানী রক্ষার মূল নৌ-পথ। এ নদীটি এখন মৃতপ্রায়। কিন্তু এখন গ্রীস্মের মাঝামাঝি সময়েই পাল্টে যেতে শুরু করেছে বুড়িগঙ্গা। রূপ আর রংয়ে বদলে যায় নদীটি।
বদলে যায় বুড়িগঙ্গার পানি। তাইতো দেশের আর সব নদীর মতই বুড়িগঙ্গার পানির রং এখন ফিরে পেয়েছে স্বচ্ছতা। আস্তে আস্তে কমতে শুরু করেছে পচা পানির দুর্গন্ধ। দেশের বিভিন্ন জেলায় বন্যা চলমান থাকায় স্বাভাবিকতার চেয়ে অতিমাত্রায় বেড়েছে বুড়িগঙ্গার পানি। সাথে সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে নদীর প্রশস্ততাও। অর্থাৎ প্রাণ ফিরেছে বুড়িগঙ্গায়। নদীর পানি বৃদ্ধিপেয়ে এটাকে এখন ঠিক নদীর মতই মনে হচ্ছে।
এখন পরন্ত বিকেলের সূর্যালোকে বুড়িগঙ্গাকে দেখলে ঠিকই মনে হবে নতুন পানি পেয়ে নদীটি যেন হাসছে। কিন্তু তার এ হাসিকে যেন সে সারা বছর ধরে রাখতে পারে সে চেষ্টা করতে হবে রাজধানীবাসী এবং নদীতীরবর্তী সমাজের সর্বস্তরের বিবেকবান মানুষদেরকে। কারণ নদীটি এখন রাজধানী ঢাকার প্রাণ ভোমরা। এটি মরে গেলে রাজধানী হিসেবে ঢাকা টিকে থাকবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
বুড়িগঙ্গাকে নিয়ে লিখেছেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। তাঁর ওই লেখায় স্বাধীনতাযুদ্ধে বুড়িগঙ্গা নদী ও তার ওপার অর্থাৎ কেরানীগঞ্জের ভূমিকার কথা উঠে এসেছে। আমার এ্যাডভোকেট বন্ধু ফিরোজ আলম তার একটি কবিতার শিরোনাম করেছেন বুড়িগঙ্গা স্বাধীনতার কথা কয়। এছাড়াও বহু কবি-সাহিত্যিক তাদের ক্ষুরধার লেখনিতে বার বার বুড়িগঙ্গার নানাবিধ গুণ বা অবদানের কথা তুলে ধরেছেন।
অথচ সেই কালের স্বাক্ষী খরস্রোতা নদীটি এখন মৃতপ্রায়। তবে এখনও বর্ষাকাল এলে বুড়িগঙ্গা ফিরে পায় তার নব্যতা। বর্ষার পানিতে ভরা যৌবন ফিরে পায় বুড়িগঙ্গা। নদীর প্রশস্তা বৃদ্ধি পায় শুকনো মৌসুমের প্রায় দ্বিগুন। নদীটির দিকে তাকালে তখন যে করোরই মন ভরে যায়। নদীর টলমলে পানিতে তখন নদী তীরবর্তী অনেকেই গোসল করতে যায়। মন ভরে সাঁতরে বেড়ায় বুড়িগঙ্গার পানিতে।
বর্ষার ২-৩ মাস বুড়িগঙ্গার চেহারা অনেকটাই পাল্টে যায়। এ সময়ে নদীটাকে ছোট-খাটো একটা নদীর মতই মনে হয়। বুড়িগঙ্গা এখন প্রমত্তা। বুড়িগঙ্গা এখন ভরা যৌবনা। এখন বাতাসে ঢেউ খেলে বুড়িগঙ্গায়। দেখতে ভালোই লাগে। সাঁতরে বেড়িয়েছি মাছ ধরেছি। কত স্মৃতি এই বুড়িগঙ্গায় তা বলে শেষ করা যাবে না। কিন্তু দেখতে দেখ নদীটা চোখের সামনেই বুড়িয়ে গেল। তবুও আজ এই বর্ষায় বুড়ির মুখে হাসি। দেখলে প্রাণটা জুড়িয়ে যায়। এমন কথাগুলো এক নি:শ্বাসে বলে ফেললেন বুড়িগঙ্গা পারের এক উদীয়মান যুবক আগানগর ইউনিয়ন শ্রমিক লীগের সভাপতি ফরিদ আহম্মেদ।
বুড়িগঙ্গা তীরবর্তী মানুষেরা আরও জানায়, এবার বর্ষা আসার আগেই নদীটির পানি বদলে স্বচ্ছতা ফিরে পেয়েছে। এটাকে তারা নদীটির একটি ভালো লক্ষণ হিসেবে মনে করছেন। কিন্তু বর্ষা মৌসুম শেষ হতে না হতেই বুড়িগঙ্গার পানি কালো রং ধারণ করে। তখন গোসল করাতো দুরের কথা বুড়িগঙ্গার পানি হাতে নেয়াই মুশকিল হয়ে যায়। পচা পানির গন্ধে দুই তীরের বাসিন্ধাদের মাঝে দেখা দেয় পানি বাহিত নানা রোগব্যধি। কারন শীত মৌসুম চলে আসার আগেই বিশ্বের সবচেয়ে দুষিত নদীতে পরিনত হয় বুড়িগঙ্গা। তখন নদীটি তার স্বাভাবিক নব্যতা হারিয়ে ফেলে। দুই তীরের পানি শুকিয়ে অনেকটা তল দেশে গিয়ে পৌঁছে।
এসময় উভয় তীরের মানুষই তাদের গৃহস্থলির বর্জ্য লোক চক্ষুর আড়ালে নদীতে ফেলে। এছাড়া দুই তীরের অসংখ্য ডাইং-ওয়াশিং মিলসহ অসংখ্য মিল কারখানার রং ও বর্জ্য নদীতে গিয়ে মিশে পানির স্বাভাবিক রংই বদলে দেয়। এসব দূরিকরণের লক্ষে অনেকের নামে অনেক মামলা মোকদ্দমাও চলমান রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা গেছে।
কিন্তু তারপরও সমাজের সর্বস্তরের বিবেকবান লোকদের কাছে একটা প্রশ্ন না করলেই নয়। সেটা হলো আমরা কী নিজেরা পারিনা নিজেদের বদলাতে? আমরা কি পারিনা নদী রক্ষায় সামান্যতম ভুমিকাটুকু রাখতে? আমরা যারা নদী তীরবর্তী এলাকায় বসবাস করছি তারা যদি সামান্যতম সচেতন হই তাহলে নদীটিও হয়তবা কিছুটা স্বস্তিবোধ করবে।
তাই আসুন বুড়িগঙ্গা রক্ষার দায় কেবল সরকার ও পরিবেশবিদদের হাতে না দিয়ে আমরা নিজেরাও নদীটিকে বাঁচিয়ে রাখতে সামান্যতম ভূমিকাটুকু রাখার চেষ্টা করি। কারণ বুড়িগঙ্গা কেবল সরকার প্রধান কিংবা পরিবেশবিদদের নয়। বুড়িগঙ্গা আমাদের জাতীয় সম্পদ। কাজেই এ নদীটি বাঁচিয়ে রাখার দ্বায়িত্বও আমাদের সকলের।