‘নদী’…কলকল, কলকল… ঢেউতোলা এই শব্দটা প্রথম কবে শুনেছিলাম ? কবে প্রথম ‘নদী’র ডাকে বুকের রক্ত ছলকে উঠেছিল? প্রথমবার কবে জেনেছিলাম নদী আসলে জলের ধারা…সে জল শীতল, মিষ্টি আবার কখনও নোনা পানি! সেদিন কি জেগেছিলাম? নাকি ছিলাম ঘুমিয়ে…স্বপ্নের মধ্যে? দুই কুল…দুপারকে বেঁধে রাখতে রাখতে এক নিমেষেই নদী… সব গিলে খেয়ে নিতে পারে! নির্বিচারে মুছে যেতে পারে– ডাঙা, ফসল, গাছপালা,… সাতমহলা কীর্তির অহংকার। নদী নাকি সে নিয়তি? তারই বা জ্ঞান হল কবে? জানি না…বলতে পারব না।
দুই.
জন্ম থেকে প্রায় বছর তিরিশ পর্যন্ত এক বিশাল ঘিঞ্জি শহরে বাস আমার। সে শহরের পশ্চিম পাড়ে পৃথিবীর বিখ্যাত নদী ‘গঙ্গা’। কিন্তু আট কি নয় বছর বয়সের আগে তাকে দেখার কোন স্মৃতি আমার নেই। হয়ত তার আগেও তাকে কিম্বা অন্য কোন নদীকে দেখেছি কিন্তু মনে পড়ে না। দেখার সম্ভাবনাই বেশি। তবুও…না, কিছুই মনে পড়ে না। প্রতি বছর গরমের কিম্বা পুজোর ছুটিতে মাসির বাড়ি নবদ্বীপে যাওয়ার সময় গঙ্গা পেরোতাম। সে এক অদ্ভূত ভাললাগা! বিশাল এক লম্বা, উঁচু লোহার খাঁচার ভেতর দিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছি ঘোলা রঙের বিপুল জলধারাকে। তখনও পালতোলা নৌকা চলত তার সাথে যান্ত্রিক লঞ্চও। বিদ্যাসাগর সেতু তখনও হয়নি। উচু উচু ঘরবাড়ির মাথা পেরিয়ে অতটা খোলা নীল আকাশ! তাতে ঐ ডিঙি আর লঞ্চগুলোর মতই মেঘ ভাসত…দুচোখ দিয়ে গিলতাম। কয়েক মিনিটে পেরিয়ে যেতাম হাওড়া ব্রিজ।
তারপর কয়লার ইঞ্জিনের রেলগাড়ি, আর তার জানালার পাশের সিট। চোখে কয়লার গুড়োর জ্বালা। আর আসন্ন মজার দিনগুলোর উত্তেজনা। রেলযাত্রার এই মজা, উত্তেজনা বেশ কিছুদিন থাকত। কিন্তু তারপর ঐ ঘোলা রঙের স্রোতস্বিনী…জাদুলাঠি দিয়ে ইশারা করত… ডাকত! ফেরার সময় বাবার সাথে হাওড়ার চাঁদপাল ঘাটে যেতাম। বাবা স্নান করতেন। আমি তাকিয়ে থাকতাম… অবিরল ঘোলা, ঘোলা স্রোত…ধারা… বিরাম নেই, ছিল না…হবেও না। কী যে হত! তখন আর কোনকিছুই মাথায় আসত না। ঐ জলধারা…অবিরাম স্রোত। ভাবতাম, এই তাহলে নদী?… একটা নিমেষের জন্যেও যার থামার ইচ্ছে নেই। ইচ্ছেমত আকাশ, মাটি, দুপারের সবাইকে ধরে আছে? যদি একবার বেশ করে জোরে সবকিছু নাড়িয়ে দেয় সে? কী হবে! অত্তবড় লঞ্চগুলোকে মনে হত মেলায় বিক্রি হওয়া খেলনা…আর ওপারের মানুষগুলো! লিলিপুটের থেকেও কুটিকুটি…ছোট্ট। ইচ্ছে করলে তো, নদী এদের সবাইকে ডুবিয়ে মারতে পারে? কিন্তু সে যেন বাড়ির বড়মা…সবার সব আবদার, অত্যাচার সহ্য করে রান্নাঘরে আর তুলসীতলায়, পুকুরঘাটে ব্যস্ত। তার মুখের ছায়ায় কোন দুঃখ নেই!
কোন কোন বার, বাবা স্নান করিয়ে দিত আমায়। সাঁতার শেখা হয়নি। তাই ভয় লাগত। জড়িয়ে ধরতাম বাবাকে। কিন্তু সেই জলে ডুব দেওয়ার পর…ওহ! সে যে কেমন লাগত! তখনও স্নিগ্ধতা, শান্তি…এগুলো আমার কাছে স্কুলের বাংলা বই-এর শব্দ। কিন্তু ‘স্নিদ্ধ’ আর ‘শান্ত’ এই দুটো শব্দের মধ্যে যে গভীর শীতলতা…মনপ্রাণ জুড়িয়ে যাওয়ার আরাম…সব কষ্ট মুছে যাওয়ার আনন্দ আছে…সেই সবকিছু আর ঐ বসে বসে গঙ্গা দেখার অনুভূতি…আমায় টানত। আমার শিরদাঁড়ার মধ্যে কী যেন আছে…তাকে জড়িয়ে টানত। শুধু মনে হত। কবে যাব…কবে যাব গঙ্গার কাছে, নদীর কাছে! মনে হত…গঙ্গা…এক জাদুকরী! জাদুই না তো কি?
হাজার পাপ, হাজার অপবিত্রতা গঙ্গার জল ছোঁয়ালে এক লহমায় মুছে যায়। কাকের মলে থাকা ব্যাক্টেরিয়া-ভাইরাস, তো নস্যি…শ্মশান থেকে দাহকর্ম করে আসা মানুষের শরীরে প্রেতসঙ্গের যে পাপ চলে আসে গঙ্গাজলের স্পর্শে তারও কোন চিহ্ন থাকে না। কয়েকশো মাইল দূরে থাকা পরিবারগুলি, এক কলসি সাধারণ জলে এক ফোঁটা গঙ্গাজল মিশিয়ে ছিটিয়ে দিয়ে চিন্তামুক্ত হয়। সব পাপ, প্রেত আর প্রেতের অনুচর রোগ-জীবানু কেউ আর তখন কিচ্ছু করতে পারে না! কিন্তু ঈশ্বর ছাড়া আর তো কারুর থাকে না? তাহলে কি গঙ্গা মানে নদী, জাদু্করী নয়…ঈশ্বর! কিন্তু ঈশ্বরকে কি এভাবে যে কেউ এতটুকুও কষ্ট না করে দেখতে পায়, ছুঁতে পারে?
এমন অনেক প্রশ্ন আমার ভাগ্যে নিয়ে এসেছিল গঙ্গা। তখনও নদী মানেই আমার কাছে গঙ্গা। আরও কিছু জলের ধারা দেখেছি, দেখছি…কিন্তু প্রশ্নের এই হাজার রহস্য নিয়ে গঙ্গাই একমাত্র ‘নদী’।
স্কুল জীবন এগোচ্ছিল আর তার সাথে ভূগোলের বিদ্যা। কত কত নদীর কথা পড়লাম। দেশের বাইরে মিসিসিপি, অ্যামাজন, টেমস, নীল নাকি নাইল…যাই হোক, ইয়াসিকিয়াং, হোয়াংহো, টাইগ্রিস, ইউফ্রেটিস, রাইন, ভোলগা, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা…ইত্যাদি। যদিও নামের জন্যই পদ্মা, মেঘনা, কর্ণফুলি এদের মনে হত আমারই ঘরের। ঘরেও আরও যে কত নাম…কৃষ্ণা, কাবেরী, গোদাবরী, সিন্ধু, যমুনা, দামোদর, অজয়, রুপনারায়ন …। তখন ইউটিউব ছিল না, আর বাড়িতে টেলিভিশনও ছিল না, তাই নামেই তারা নদী হয়ে থাকল।
গঙ্গার পর প্রথম দুচোখ দিয়ে দেখলাম অজয়কে। এক বিকেল আর সন্ধ্যার মিলন সময়ে দেখলাম, ঘোলা জলের ধারায় কীভাবে সবুজ রঙ মিশে যাচ্ছে। তারপর সেই ঘোলা রঙ নিয়ে ছুটে চলেছে গঙ্গা। সেই প্রথম মনে হল…আরে, নদী তো শুধু জলের ধারাই নয়। সে তো বহমান প্রাণের ধারাও বটে। বিপুল এক হৃদয় নিয়ে বয়ে চলছে। ভালবাসার এক আশ্রয়। যেখানে ভালবাসার টানে রঙই শুধু নয়…মিলে যায় দুই অস্তিত্ব। আমাদের বড় আদরের কবির কবিতায় পড়েছিলাম; ‘…তারই নীচে শুয়ে থাকি আমি অর্ধনারীশ্বর…’ ঠিক যেন তাই। অনন্য অনুভবে সেদিন দুই জলধারা ভিজিয়ে দিয়েছিল আমায়।
এরপর কলেজ আর কাজের জীবনের প্রথম দিকে দেখা পেলাম। সুবর্ণরেখা আর কংসাবতীর। ততদিনে জেনে গেছি বৃষ্টির জলে পুষ্ট নদী আর বরফ-গলা জলের নদীদের ভূগোল। যখন দেখলাম তখন দুজনেরই বিশাল শুকনো খাত তার মাঝে সামান্য জলের ধারা, এই আছে তো এই নেই! কিন্তু দেখার পরেই খুব মন খারাপ হয়ে গেল। জানতাম বর্ষার জলে তারা ভয়ঙ্কর…তবুও মন যেন মানতেই চায় না। ওরা নদী? …একদলা কান্না আটকে ফিরে এসেছিলাম। অনেক পরে যখন ভরা বর্ষার দামোদর, রুপনারায়ণকে দেখেছিলাম। তখন ভুল ভাঙল। না… গঙ্গার সাথে মিলের জন্যে নয়।
বুকে দুহাত দিয়ে জলের গর্জন মেখে নিতে নিতে সেসময়ে মনে হয়েছিল। শুধু এরা কেন…পুরো মালভূমি থেকে সেই হিমালয় পাহাড়। সব জলের ধারার একটাই তো গতিপথ…। কোন না কোনভাবে সেই জল এসে মিশছে গঙ্গায়। তাই তো গঙ্গার এত শক্তি…এত জাদু! আরও অনেক অনেক পরে উত্তরাখন্ডের পথে যখন উপরে উঠছি…তখন এই উপলব্ধি আরও সত্যি হয়ে উঠল। স্বর্গের দেবীরা…অলকানন্দা, মন্দাকিনী…আরও কত যে নাম…অজস্র, নিজেদের রঙ… স্বপ্ন, ভবিষ্যত নিয়ে মিশে যাচ্ছে আর একটু একটু করে গড়ে উঠছে আমাদের গঙ্গা! বিশাল…বিপুল এক বিচিত্র জনগোষ্ঠীকে সে ভালবাসে, বাঁচিয়ে রাখে, স্বপ্ন দেখায়…সভ্যতার ধাত্রী সে। শৈশবে যেভাবে গঙ্গার বিস্ময় আমার কাছে নদী আর গঙ্গা দুই শব্দকে এক করে দিয়েছিল একইভাবে এই উপলব্ধিও গঙ্গার স্রোতের মতই বয়ে চলল।
এরপর সেই ছেলেটা কর্মসূত্রে পৌছে গেল আর এক ঘিঞ্জি শহরে। তবে সেটা কোন মেগাসিটি না, এক মহকুমা সদর শহর। মফস্বল বলেই লোকের কাছে পরিচিত। কিন্তু তার মনে হয়েছিল সেটা একটা ফিতের মত লম্বা বাজার। নামের মধ্যেও তার ‘হাট’ শব্দটা আছে। আর আশ্চর্য এ শহরের গা দিয়েও বয়ে গেছে আর এক নদী…ইছামতি। ছেলেটা যখন প্রথমবার জানতে পারল বাকি জীবনটা ঐ শহরই তার ভবিতব্য। (সেই সময় ঠিক এটাই সত্যি ছিল।) তখন একটাই ইংরেজি শব্দ অজান্তে বেরিয়ে এসেছিল মুখ থেকে; ‘কো-ইন্সিডেন্স’!
সেই ছোটবেলা থেকে নামটা ভেসে উঠত…ইছামতি…বারবার! এক ঘোলাজলেরই ধারা যেন! তার নির্জন তীর-ডাঙায় একটা ছোট্ট কুঁড়ে। সেই কুঁড়ের বারান্দায় বসলে দেখা যায়… সন্ধেরাতের তারারা নেমে আসছে নদীর স্রোতের ওপর। এ কি, রবিঠাকুরের কবিতার জন্য? কিন্তু বলতে এতটুকু দ্বিধা নেই…রবি ঠাকুরের সেই বিখ্যাত কবিতা বা বিভূতিভূষণের উপন্যাস সে পড়েছে কৈশোরের প্রায় শেষবেলায়। কিন্তু নামটা…সে বয়ে বেড়াত। যাই হোক দীর্ঘ ষোল বছরের বসবাস এই শহরে। তার মধ্যেই সুন্দরবনের অনেকের সাথে দেখা হল। বিদ্যাধরী, কাটাখালি, কালিন্দী, মাতলা…এমন অনেকের সাথে। তারাও সবাই সুবিপুল ঘোলা জলের স্রোত।
ভূগোল বলে বঙ্গোপসাগরের জল, জোয়ার-ভাঁটায় আসে যায়। তাই এত ঘোলা রঙ! তাদের কাছে থাকা হয় না। ক্ষণিকের আলাপ সেরে পালিয়ে আসতে হয়। কিন্তু…ইছামতি! শহরের মধ্যে সে তো কোমরে দড়িবাঁধা কয়েদি! আর মিডিয়ায়, খবরের কাগজে শুধুই তাকে গলা টিপে মারার ছবি।
বেশ কয়েক বছর পর। কবি-গল্পকার রাজু বিশ্বাস, কবি সৌমেন মন্ডল, ছবি-পাগল সাইফুল নিয়ে গেল একেবারে ইছামতির বুকের কাছে। পাড়ে কিম্বা মাঝধারায়; দুপুর কী বিকেল কিম্বা সন্ধে হয়ে সারারাত…তারপর শুধুই ইছামতি। রাজু বলে, হয়ত যুক্তি নেই… তবু বলে;
‘ বাড়ি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেই ইছামতি ডাকে…আর ঘুম আসে না…সংসার উথালপাতাল হয়ে যায়! দৌড়ে চলে যেতে হয় ইছামতির কাছে…তারপর একবুক কান্না…অকারণ কান্না!’
না…আমি তো কলকাতার জবরজং! কান্না আসেনি আমার। কিন্তু…ইছামতির জলে ভেজা ঘাস, বাঁকের চড়ায় জ্যোৎস্না-পরীদের নেমে আসা, মাঝরাতের ফিসফিসে কলকলানি আর বিকেলের জলরঙা মেঘ…এইসব… সর্বনাশা অস্ত্র নিয়ে ইছামতি আমাকেও আক্রমণ করে। নেশা, না না…রোগ লেগে যায়! কাজের অবসর পেলেই ছুটতে হয় তার কাছে। তার সবুজ ঢালু পাড়ে শুয়ে থাকলে কতদিনের কাঙ্ক্ষিত ঘুম চলে আসে ! অদ্ভূত…লোকে দেখলে পাগলই বলবে! নির্জনে, একান্তে ইছামতি কথা বলতে শুরু করে আমার সাথে। কত যে গল্প আমাদের দুজনের…আনন্দের, মন খারাপের, হাসির, মজার! মিন ধরতে আসা গ্রাম্য বধূরা অনেক দূ্রে মুখে কাপড় চাপা দিয়ে হেসে যায়।
আমি ইছামতির গল্প শুনি। ভূগোলের সেই কথাটা খুব সত্যি হয়ে ওঠে! গাঙ্গেয় সমভূমির সব নদীই আসলে এক…এক থেকে বহু রূপ। তেমনই পৃথিবীর সব জল… সে অ্যামজনই হোক কিম্বা ক্যাস্পিয়ান সাগর বা ডাল লেক অথবা আমাদের প্রায় শুকিয়ে যাওয়া পিয়ালী, বিদ্যাধরী কিম্বা রিভার বাংলা সম্পাদকের বড় আদরের নরসুন্দা বা সোনাই নদী, কাদার বিল…মাটির নীচে পেয় জলের ভান্ডার অথবা সারা পৃথিবীর আকাশজোড়া রামধনু-মেঘ… সব জল, জুড়ে আছে মহাসমুদ্রদের সাথে; আমাদের চোখের সামনে কিম্বা চোখের আড়ালে। তাই নদী আসলে একটাই! কোথাও সে বর্ণহীন, কোথাও নীল, সবুজ, কালো। আর আমার রক্তের প্রতিটি কণায় তার রঙ… ঘোলা, গঙ্গা হয়ে ইছামতি। তবে ইছামতি এত লক্ষ্মী মেয়ে কিন্তু না! গাঁয়ের মেয়ে তাই ডানপিটেমি যাবে কোথায়? মাঝেমাঝেই তীরের বাঁধ, ভেড়ি গিলে ফেলে। তখন তার গল্পের ঝাপি বন্ধ। দর্শণের সত্যি আর সত্যদর্শণ সেই মুহূর্তে নদীর স্রোতে মিশে যায়।
কৃষ্ণপক্ষের রাতে, তারা চুমকিদের নীল আভা আকাশগঙ্গাকে দেখায়। নীচে ইছামতি… আঁধারের রঙ মাখে। আমায় ঘিরে রাখে একমাত্র স্রোতের কুলুকুলু। আচ্ছা…ইছামতি কী গান গাইছে! ঘুমপাড়ানি গান?…ক্লান্ত, শ্রান্ত সন্তানকে মা তো গান গেয়েই ঘুম পাড়ায়! আরেকবার শুয়ে পড়ি ইছামতির জলের শরীরে। নদীমাতৃক সন্তান আমি, আমরা…আমাদের দেহতরীও নদীর ঢেউজলে গড়া। এই শরীরে জলই তো সব! বাইরে যে গঙ্গা কি মেঘনা কি ইছামতি সেই তো কখনও কাঠামোতে রক্ত-নদী কখনও দেহতলে অশ্রুগঙ্গা আবার কখনও অনেক গভীরে যার কোন তল নেই সেই গোপনে… অন্ধকারে, চেতনা-প্রবাহ। অনন্ত এক নদীর বুকে…নদীর ত্রিধারা হয়ে ভেসে চলেছি আমরা।
গঙ্গার ধারা একদিন নিজের নাম আর নদীকে এক করে দিয়েছিল…চিনিয়েছিল কাকে বলে নদী যার আর এক নাম ভালবাসা, আশ্রয় আবার নিয়তিও বটে। দিনে হোক কিম্বা রাতে, চোখের সামনে বা আড়ালে এখন ইছামতি বলে যাচ্ছিল; নদীর প্রত্যেকটা জলের বিন্দু মিলিয়েই আমরা আছি…আমাদের অস্তিত্ব। নদী ছাড়া আমার, আমাদের কোন অস্তিত্বই নেই!
পাঁচ.
নদী নিজে যখন তার সন্তানকে, শেকড় চিনিয়ে দেয়। তখন নদীর আদরের সন্তানরা কি দূরে থাকতে পারে? তাই যে ভাইটা কবে বড় হল বুঝতেই পারিনি। এখনও যার গাল টিপে আদর করতে ইচ্ছা করে। সেই নদীকর্মী তাপস দাস, একদিন পাকড়াও করল ছেলেটাকে…মার্জনা করবেন, লোকটাকে। ছেলেটা তো এখন মধ্যবয়স্ক! নদীর কর্মী…তাপস নিয়ে গেল আরও অনেক নদীর কাছে…আত্রেয়ী, পুনর্ভবা, টাঙ্গন…দামোদর, ভৈরব…। কত, কত যে নদী নামের আধমরা, প্রায়মরা শরীর লোকটা দেখল! প্রতিটা দৃশ্যের শেষে…শুধুই ধিক্কার! তখন… আত্মগ্লানিতে সে জর্জরিত। এতদিন নদীর বলা ‘দর্শণ’, নদীর ভূগোল, নদীর রুপ আর নদীর সন্তানদের কষ্টের কথা বলে গেছে সে। কিন্তু নদীর নিজের ব্যাথা, যন্ত্রণা…একটু একটু করে অবধারিত বধ্যভূমিতে এগিয়ে যাওয়ার ত্রাস। তার কথা কে বলবে! পরশুরামের উত্তরপুরুষ আমরা। তাই তো নিজের মাকে খুন করাটা অনিবার্য, ভবিতব্য! আবার কখনও গর্বেরও বটে! আমরাই তো একদিন খুন করেছি বৈদিক সরস্বতীকে। আর আজও রেলব্রিজ বানিয়ে ইছামতির মুন্ডু সমেত অর্ধেকটা কেটে ফেলেছি। বিশাল সব ব্যারেজ বানিয়ে দামোদরকে পঙ্গু করেছি, একশ কিলোমিটার পরপর বাঁধ বেধে গঙ্গাকে সম্পূর্ণভাবে খুন করার পরিকল্পনা করছি। কারা করছে…আমরাই!
কিন্তু মা তো কখনও সন্তানের কাছে কিছু চায় না!একবুক অভিমান নিয়ে সে অপেক্ষা করে থাকে। কখন তার সন্তান মাতৃত্বের মর্যাদা দেবে? তাই গঙ্গা কিম্বা ইছামতি কেউ কোন নালিশ করে না। মুখে হাসি আর বুকে ব্যাথা নিয়ে বইতে থাকে। লোকটা কী করবে? সে তার জানালা দিয়ে রাতের আকাশ দেখে!…অদ্ভূত ! আকাশে চাঁদ, কিন্তু নীল আকাশ কই? এ তো কুচকুচে কালো…চোখ কচলায় সে। না সেই তো কালো আকাশ ! সে অপেক্ষা করতে থাকে। দিনের আলো ফোটে… সেই কালো আকাশ! কোথায় গেল আকাশের নীল রঙ? সে পাগলের মত বেরিয়ে আসে বাইরে। দৌড়ে যায় ইছামতির কাছে…একফোটা জল নেই কোত্থাও…মাইলের পর মাইল শুকনো খাত। সে এবার দৌড়ে যায় গঙ্গার কাছে…তারও তো মৃত্যু হয়েছে। মারা গেছে সবাই যে যেখানে আছে, মিসিসিপি থেকে গোদাবরী! আকাশে নীল নেই, নদীতে জল নেই, মাঠে, ঘাটে, পাহাড়ে কোত্থাও একচিলতে সবুজও নেই। চারিদিকে কিলবিল করছে প্ল্যাস্টিকের খোলস আর মুখোশে ঢাকা মানুষ। … কালো আকাশে লাল বিদ্যুত ঝলসে বাজ পড়ে একের পর এক। অ্যাসিড বৃষ্টি শুরু হয়। লোকটার সারা গা পুড়ে যায়। জ্বলতে জ্বলতে লোকটা, খোঁজ করে অন্তত এক আঁজলা জল…নদীর জল…ইছামতি, গঙ্গার জল…মিস্টি জল। পায় না সে…দম বন্ধ হয়ে আসে। তারপর…
দুঃস্বপ্ন ভেঙে যায়। সে ধড়ফড় করে উঠে বসে। কাগজ আর কলম নিয়ে নদীর কথা লিখতে যায়। কিন্তু কী অক্ষম লোকটা! তার কলমের ডগায় নদীর বুকের রক্ত ফোঁটাফোঁটা জমতে থাকে। কাগজের ওপর কিছু আবছা আকিবুকি ফুটে ওঠে!
নদীর সাথে ভাব নদীর সাথে আড়ি
উপড়ে গেল শেকড়বাকড় কঠিণ মহামারী
সকাল বিকেল সাঁঝে অন্ধ দুপুর রাতে
বুকের ভেতর চাঙড় ধ্বসে নদী হাঁপায় কাঁদে
যায় মুছে সব রেলের টিউব শপিং ব্রথেল মল
আয়নাখানার ভাঙা কাঁচে নদীর চোখের জল
নিপুণ বাজার কান ছিঁড়ে নেয় ঘা ভনভন হাত
পাঁজর ভাঙে দামাল প্লাবন শুকনো নদীর খাত
আধবুড়ো লোকটা বন্ধ করে কলম। দুচোখ বন্ধ করে অনুভব করার চেষ্টা করে । তার শরীরে, চেতনায়, অস্তিত্বে…তার ভূগোলে… ছিল, আছে, থাকবে… একটা, একটাই নদী…বিস্ময়ে হতবাক করে, নিয়তি হয়ে টানে আবার ভালবাসা হয়ে আশ্রয় দেয়…কখনও সে গঙ্গা…কখনও ইছামতি…নদী একটাই। নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে লোকটাকে। পারবে কী? নদী তো একটাই…
মরা নদীর গল্প ।। অনিন্দ্য আাসিফ
কালনির স্নিগ্ধতায় আমার ছেলেবেলা ।। আলম মাহবুব
“নদী সেতু হয়ে আছে আমাদের বন্ধুত্বে”