জীবনের দৈনন্দিনতাটুকু আড়াল হলেই কল্পনায় শুনতে পাই দশদিক কাঁপিয়ে স্টীমারের ভোঁ বেজে উঠছে। অসংখ্য যাত্রীর ওঠানামায় কলমুখর হয়ে উঠেছে কালীগঙ্গার তীর। দারুণ নস্টালজিয়া ভর করে। ছুটে যাই নদীর তীরে। দেখি বিশ্বকবি একটা চেয়ার টেনে জানালার ধারে বসে আনমনে লিখে চলছেন। দখিনা বাতাসে তাঁর আলখেল্লা উড়ছে, শুভ্র দাড়ি-চুল বিপর্যস্ত। কোনদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই তাঁর, ধ্যান-মৌন ঋষি সৃষ্টিশীলতায় মগ্ন। তাঁকে ঘিরে রয়েছে একটা উজ্জ্বল জ্যোতি।
হ্যাঁ, সেদিনের খরস্রােতা কালীগঙ্গার বুকের ওপর দিয়ে তুমুল আলোড়ন তুলে চলত কোলকাতা থেকে বরিশালগামী স্টীমার “সরোজিনী”। রবীন্দ্রনাথের মেজদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর বিলেতি কোম্পানীর সাথে পাল্লা দিয়ে এই জাহাজের ব্যবসায় নেমেছিলেন। আপাদমস্তক শিল্পী এই লোকটি ছিলেন একেবারেই বিষয়-বুদ্ধিহীন। তবু তাঁর অন্তরে যে স্বদেশ ভাবনার স্ফুলিঙ্গ ছিল তার বহিঃপ্রকাশ ছিল এই যন্ত্রযান। আর সেই স্টীমারে চড়ে কবিগুরু এই কালীগঙ্গার বুকের উপর দিয়ে বরিশাল শহরে গিয়েছিলেন।
এই গৌরবময় স্মৃতির পাশাপাশি কালীগঙ্গা নদীর আর একটা স্মৃতি বিষাদাক্রান্ত করে তোলে। ১৯৭১ সন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ভয়ঙ্কর দিনগুলোয় শত শত নৌকায় পরিবার-পরিজন নিয়ে মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ভারতে চলছে। নদীর বুক জুড়ে ভীত-সন্ত্রস্ত, অসহায় মানুষগুলো এমনিতেই দিশেহারা। হঠাৎ হানাদারবাহিনীর একটা গানবোট আসে। আতঙ্কে সবার বুক হিম হয়ে যায়। যার সুযোগ ছিল সে পার্শ্ববর্তী কোন খালের মধ্যে ঢুকে পড়ে। বাকিরা মৃত্যুর প্রহর গুণতে থাকে। কিন্তু গানবোট থেকে সেদিন একটাও গুলি ছোঁড়েনি দখলদারবাহিনী। সেদিন তাদের লক্ষ্য ছিল অন্য কোন বড় আক্রমণের দিকে। তাই নদীর স্রােত রক্ত-লাল হতে গিয়েও থমকে গিয়েছিল।
এই নদীটির সাথে জন্ম থেকে জড়িয়ে গেছে আমার জীবন। সবাই নদীর পাড় থেকে লোকালয়ে গিয়ে আবাস বাঁধে। আর আমি মানুষের রূঢ় আচরণে, কৃতঘ্নতায় জনপদ ছেড়ে কালীগঙ্গার তীরে এসে বসত গেড়েছি। শৈশবে একবার প্রায় নদীর গ্রাসে পৃথিবীর আলো নিভে এসেছিল আমার। দুঃখ-সুখের নানা উপলক্ষ্যে সেদিনটি বহুবার স্মরণে এসেছে।
বৈশাখ মাস। নতুন বছরের নতুন জোয়ার। দক্ষিণা বাতাস সেদিন উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল। ভীষণ উত্তাল ঢেউয়ের মাঝে বাবার সাথে নদী পাড়ি দিই। মাঝামাঝি প্রায় চলেও আসি। কিন্তু হঠাৎ আকাশ সমান একটা ঢেউ চলে যায় আমাদের ছোট্ট নৌকাটার উপর দিয়ে। মুহুর্তকাল মাত্র সময়। কি ঘটে গেছে বুঝে ওঠার আগেই দেখি বাবা এক হাতে আমার হাতটা শক্ত করে ধরে আর হাতে নৌকাটা ধরে ভাসছে। আর আমি বাবার হাত আঁকড়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদছি। কোথা থেকে দু’টো জেলে ডিঙি এগিয়ে এসে আমাদের উদ্ধার করে।
বোধহয় তার প্রতিদানস্বরূপ বছর দশেক পর এই নদীর বুকেই আর এক ঘটনার মুখোমুখী হই। সেটা দুর্ঘটনা নাকি সৌভাগ্য আজও ভেবে পাইনি। তবে যুগ যুগ ধরে সেই স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছি। বিকেলবেলা কলেজ থেকে ফিরছি। লঞ্চ যখন ছাড়ে তখন উত্তর-পশ্চিম কোণে এক টুকরা মেঘ। তেমন চোখে পড়ার মত কিছু নয়। এটা ছিল দিনের শেষ লঞ্চ। ভিতরে এত বেশি লোক যে বসার সুযোগ নেই। পাশেই দারুণ রূপসী এক যুবতী তার বিউটি ব্যাগটা পাশে রেখে আয়েস করে বসা। মনটা উশ্খুশ্ করছিল ব্যাগটার জায়গাটুকু দখল করে একটু উষ্ণ সান্নিধ্যে বসার জন্য। কিন্তু ভাবতেই বুকের মধ্যে এমন ঢিপঢিপ শুরু হয় যে কয়েকবার চোরা চাউনিতে দেখা ছাড়া আর কিছু সাহসে কুলায়নি। একটু সুখ হয়েছিল বার কয়েক আমার চাহনির প্রতিফলন দেখে। কিন্তু তা যে সুখের প্লাবন নিয়ে আসবে তখন কে জানত!
হয়তো আমার সুখের জন্যই প্রকৃতি হঠাৎ রুষ্ট হয়ে ওঠে। সেই তুচ্ছ মেঘখন্ডই দিক-দিগন্ত ভয়াল কালো আঁধারে ঢেকে দেয়। শুরু হয় কালবৈশাখীর রুদ্র তান্ডব। কালীগঙ্গার এমন ভীষণ রূপ আগে কখনো দেখিনি। আট্টহাস্যে এক একটা তরঙ্গ আছড়ে পড়ে আর মনে ভাবি এই বুঝি মৃত্যুর স্বাদ নিতে যাচ্ছি। চালক কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সবাই প্রথম কতক্ষণ স্রষ্টার নাম নিয়েছিল। কিন্তু তাতে ঝড়ের বেগ দুর্বল হল না। তারপর শুরু হল চিৎকার করে কান্নাকাটি। চারপাশের অবস্থা দেখে আমার আর কান্নাকাটি করতে ইচ্ছে হল না।
অথবা বুদ্ধিসুদ্ধি কম বলেও এমন হতে পারে। কথায় বলেনা- বোকা লোকের ভয় কম! কিন্তু হঠাৎ যে অভাবনীয় ঘটনাঘটলতা আজো আমাকে শিহরিত করে। সেই বিদ্যুতের শিখার মত সুন্দরী এসে আমাকে জাপটে ধরে আমার সবার্ঙ্গ জড়িয়ে থাকে। জীবনে প্রথম নারীস্পর্শ। মানুষ এত সুরভিত হয় তা এই প্রথম জানলাম! আমার ভিতরে যে ঝড়ের প্রচন্ড তান্ডব শুরু হয় তার তুলনায় কালবৈশাখী তুচ্ছ! এই নদীর বুকে সেই ঝড় আমার ভিতরজন্ম দিয়েছে ভিন্ন এক কৌতুহল। আজও যখনই লঞ্চেচড়ে কোথাও যাই কল্পনায় দেখি ঝড়ের কবলে পড়া সেই লঞ্চটাকে আর ভীত-সন্ত্রস্ত একটা সুন্দরপাখি যেটা আমার বুকে আশ্রয় নিয়ে কাঁপছে।
এই নদীটির নাম কালীগঙ্গা। বাংলাদেশের দক্ষিণ জনপদের জেলা পিরোজপুরকে সমান দুই ভাগে ভাগ করে বয়ে গেছে উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে। গোপালগঞ্জের উপর থেকে বয়ে আসা মধুমতী এবং বরিশালের পশ্চিম সীমানা থেকে নেমে আসা বেলুয়া নদীর মিলিত ধারা কালীগঙ্গা নামে পিরোজপুর জেলা শহর পর্যন্ত এসে সন্ধ্যা নদীর ধারার সাথে মিলে কচা নদী নামে চলে গেছে বঙ্গোপসাগরের দিকে।
এক সময়ের প্রবল খরস্রােতা এবং বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিশেষ গুরুত্ববহ নদীটি নাব্যতা হারিয়ে আজ ধুকে ধুকে চলছে। মানুষের প্রয়োজনে, সভ্যতার বিনির্মাণে নদীর উপর যে সেতু নির্মাণ করা হয়েছে তার ফলে স্বাভাবিক গতিপথ ব্যাহত হয়ে ধীরে ধীরে সরু হয়ে গেছে। তবু জীবন প্রবাহের সাথে বহতা কালীগঙ্গা নদীটি একাকার হয়ে মিশে আছে। যেখানেই যাই বুকের ভেতর এই নদীটির কলগর্জন শুনতে পাই। আমার জীবনধারা, জন্মভূমির দ্যোতক হয়ে আমার সত্ত্বার সাথে মিশে থাকে প্রাণের দোসর কালীগঙ্গা।
সন্তোষ কুমার শীল : লেখক। পেশায় শিক্ষক। প্রকাশিত বই- “স্বপ্নযাত্রা”, “প্রস্তরময়”, “বৃদ্ধ লোকটি ও একটা চারাগাছ”, “অজেয়”, “একটি স্বেচ্ছামৃত্যু ও কিছু রসিকতা”, “রবীন্দ্রনাথের বাবা স্বপ্ন দেখেছিলেন”- (ছোটগল্প সঙ্কলন) ও “দুঃখ জয়ের গান”- (উপন্যাস)।
আমাদের ছোটো নদী ।। গৌতম অধিকারী
আড়িয়াল খাঁ নদ- স্মৃতি ও বাস্তবতায় ।। হাসান মাহবুব