রাস্তার নাম “করুণাময়ী ঘাট রোড”। ‘ঘাট’ কোন কালে ছিল? সেই ঘাটের রাস্তায় কারা, কোথায়, কোথায় যাওয়া-আসা করতেন? কী ছিল ঘাটের কড়ি? সঙ্গে থাকতো কী? জানা নেই। কে জানেন তাও জানা নেই। আমার ঐ পথ দিয়ে যাওয়া-আসা শুরু হয় ১৯৮৬-৮৭ সালে। তখনো করুণাময়ী ব্রীজ হয়নি।
গাড়ী পথে কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ সিরিটি-ভাটিখানা-মহাবীরতলা হয়ে টালিগঞ্জ ব্রীজ পার পথে। সোদপুর বাজারে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়ানো পথিককে কোথায় যাচ্ছো প্রশ্ন করলে উত্তর আসতো, “কলকাতা যাচ্ছি”। বেহালা মিউনিসিপালটি ‘এডেড এরিয়া’’রূপে কলকাতায় যুক্ত হলেও পুরনো অভ্যাস তখনো রয়ে গিয়েছে। আর হবে নাই বা কেন বড় বড় ইট ভাটার মাঠ-ঝিল, উষা কম্পানি মালিকানার বিভিন্ন কারখানা, গাছ-গাছালি-পুকুর নিয়েই তখনকার সৌয়দপুর মৌজা জনপদ।
করুণাময়ী ব্রিজের কাজ শুরু হলে বাঁশের একটি সাঁকো তৈরি হল। আস্তাবলের মাঠ হয়ে নানুবাবুর বাজারের সঙ্গে করুণাময়ীকে যুক্ত করতে। সেটাই ছিল আমার পছন্দের স্কুল যাওয়ার পথ। যদিও মা’র নির্দেশ ছিল ঋষি আশ্রমের কাঠের পোল দিয়েই আদি গঙ্গা পার হতে হবে। ঋষি আশ্রমের ব্রীজ এই নামই জানি ছোট থেকে। এর থেকে বেশী জানা হয়নি। কাঠের পুল পার হওয়ার সময় জোয়ারের ঘোলা জলের স্রোত কোন দিকে যায়, তাই দেখে নেওয়াই ছিল জীবনের প্রথম নদী দেখার কৌতুহলী মন।
স্কুলে বন্ধুদের কৌতুক ছিল, বলতো পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য কি? সপ্তম আশ্চর্য তো বইতে ছিল তবে অষ্টম কোনটি? যারা আগে জানতো বলে উঠতো ‘টালি নালা’ যে ড্রেনে জোয়ার-ভাটা খেলে। আমার প্রিয় নদী হয়ে ওঠার কথা ছিল যে নদীর সেই ‘আদি গঙ্গা’ হল টালি নালা। রেনেলের ম্যাপে যে নদীর খবর আছে। বাঙালির প্রাণ বাঁধা আছে যে চৈতন্য প্রেম গাঁথায়, সেই চৈতন্য ভাগবতে যে নদীর উল্লেখ আছে । সেই নদী হল আমাদের ঠাট্টার জোয়ার-ভাটা খেলার ড্রেন।
সুধীন বন্দ্যোপাধ্যায় এর ‘বেহালা জনপদের ইতিহাস’ বই তখনো হাতে আসেনি, তাই খুঁজে দেখা হয়নি এই অঞ্চলের ভূগোলের ইতিহাস। সাবর্ন চৌধুরী পরিবারের স্থাপিত করুণাময়ী মন্দির, সিদ্ধেশ্বরী মন্দির, গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে সিরিটি শ্মশান। আবার ঋষি আশ্রম, এত কাছাকাছি কয়েকশো বছরের ইতিহাসের সাক্ষী মন্দিরগুলো তৈরি হয়েছিল কারণ ‘আদি গঙ্গা’ ছিল প্রাণ প্রবাহী। স্বয়ং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়মিত আসতেন তান্ত্রিক সাধকের প্রতিষ্ঠিত সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরে।
প্রকৃতি তার আপন খেয়ালে ভাঙে-গড়ে মানুষ-জীবকুল সেই খেয়ালেই চলে। অতীত থেকে বর্তমান -বর্তমান থেকে ভবিষ্যৎ, অবিরাম- অবিরত- অবিরল জীবন প্রবাহ। গঙ্গার অতীত থেকে বর্তমানে ‘আদি গঙ্গা’ টালি নালা হয়ে শহরের নর্দমায় পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু নদীর প্রবাহকে কেন্দ্র করে যে মানব সমাজ গড়ে উঠেছিল তার বদল তো সহজ নয়। তাই তা রয়ে গিয়েছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাকে বহন করে চলেছে। প্রাকৃতিক অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে জীবন-জীবিকা পরিবর্তিত হয়েছে নির্দিষ্ট ভৌগলিক অঞ্চলে। প্রকৃতির আশীর্বাদকে মানুষ ব্যবহার করেছে আবার অপব্যবহারে তাঁকে হারিয়েছে।
আবার কখনো প্রকৃতির আপন নিয়মে মুখ ফিরিয়েছে শত চেষ্টাতেও ফিরে আসেনি আগের রূপে। ‘আদি গঙ্গা’ তেমনি গোবিন্দপুর ক্রীক থেকে টালি নালা হয়ে ফিরে এলেও সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হলেও তা কখনোই প্রকৃতির নিয়মে হয়নি তাই আগের রূপ ফিরেও পায়নি। যখন থেকে নদীকে অক্ষ ধরে পরিবেশকে বাঁচিয়ে, বেঁচে থাকার প্রয়োজনকে বোঝার চেষ্টা করে চলেছি তখন থেকেই বারবার নিজেকে প্রশ্ন করেছি ‘আদি গঙ্গা’ কেন প্রিয় নদী হয়ে ওঠেনি? এই নদীর এত কাছে আজন্ম বসবাস করেও। তা কী শুধু তার পুঁতি গন্ধময় জলের জন্য না কী এই ভূ-প্রকৃতির কোন প্রয়োজন হয়নি জীবন-জীবিকায়।
সমুদ্রে বিলিন হওয়ার আগে এই স্রোত ছিল যাত্রার অনুকূল। তাই গঙ্গাসাগর হোক বা সমুদ্রপথে বিদেশযাত্রা হোক ‘আদি গঙ্গাই’ ছিল নাবিকের পছন্দ। কলকাতার উপকণ্ঠে বৈষ্ণবঘাটা। কথিত জগন্নাথধাম যাত্রার সময় ঐ অঞ্চলের কোন এক পুকুরে সপার্ষদ স্নান সেরেছিলেন গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু্। বৈষ্ণবদের ঘাট থেকেই বৈষ্ণবঘাটা ধারণা করা হয়। গড়িয়া, বারুইপুর, সূর্যপুর, আটঘরা, ছত্রভো গ, বড়াশি হয়ে ‘আদি গঙ্গা’ পৌঁছেছিল সাগর সঙ্গমে। তার বেশীর ভাগই আজ বিছিন্ন মজা-জলাশয় হয়েছে। বিপ্রদাসের মনসা মঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, চৈতন্য ভাগবতে বাঙালির গঙ্গা বারবার উল্লেখিত। বেহুলার স্মরণে এয়োদের ব্রত থেকে চৈত্র মাসে কাশীপুরের চক্রতীর্থ গ্রামে নন্দা স্নান উপলক্ষে মেলা। এই নদীর গৌরব গাঁথা বর্ণনা করে চলে। ছত্ররভোগের পরিচয়ে চৈতন্য ভাগবত বলছে-
ছত্রভোগে গেলা প্রভু অম্বুলিঙ্গ ঘাটেশতমুখী গঙ্গা প্রভু দেখিলা নিকটে।
কথিত নবাব আলিবর্দি খাঁ এলেন গাজন মেলায়। মাটিতে পুঁতে দিলেন বর্শা, পরীক্ষা হবে সন্যাসীদের। স্বয়ং ভগবান শিব শঙ্খ চিলের বেশে এসে বললেন, ‘দাও ঝাপ’। বিশ্বাসী সন্যাসীর ঝাপে বর্শা গেল ভেঙে। মেলা-মন্দির হল বিখ্যাত। বর্শা ভঙ্গ আর তা থেকেই গ্রামের নাম হল বড়াশী। আর শিব জাগ্রত হয়ে রইলেন ‘অম্বুলিঙ্গ’ নামে। এই গ্রামে এসেই মহাপ্রভু দেখলেন নদীর শতমুখ। ছত্রভোগে শাসনকর্তা রামচন্দ্র খাঁ নস্কর তীর্থ ভ্রমনের সমস্ত ব্যবস্থা করলেন। শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু চললেন শ্রী ধামের উদ্দেশ্যে। এহেন বাঙালির অন্তরের প্রাণ পুরুষের স্মৃতি বিরচিত নদী হারালো গৌরব। ‘বিস্মৃত জাতি’ বারবার তার অন্তর আত্মাকে স্মরণে রাখতে ভুলেছে। তাই তো অসংখ্য মানুষের প্রিয় নদী হয়ে থাকলো না ‘আদি গঙ্গা’।
১৭৭২-৭৭ সাল ধরে খিদিরপুরের দই ঘাট থেকে কালীঘাট পর্যন্ত খাল কাটলেন কর্নেল উইলিয়াম টলি সাহেব। তখন এই গ্রামের নাম গোবিন্দপুর। সেই থেকেই নদী নাম পেল ‘টলি নালা’ বা ‘টালি নালা’। তার অল্প কিছু আগে রেনেলের সার্ভের ম্যাপে নদীর নামহীন উপস্থিতি থাকলেও উৎসমুখকে ম্যাপের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া যাবে না। গোবিন্দপুর থেকে বড় হতে হতে আজকের তিলোত্তমা কলকাতা। শহর পরিস্কার রাখতে ফোর্ট উইলিয়াম থেকে দক্ষিণ কলকাতার প্রান্ত পর্যন্ত অসংখ্য নর্দমা মেশে টালি নালায়। পশ্চিম পুটিয়ারি থেকে গড়িয়া পর্যন্ত ২০ মিটার অন্তর ৩০০ মেট্রো রেলের থাম আর কংক্রিটের বাঁধানো পাড় নদীকে সম্পূর্ণ রূপে নিকাশী নালায় পরিণত করেছে। যাকে আর কোনদিন নদী বলা যাবে না। সে থেকে যাবে আমাদের অবজ্ঞা-অবহেলার ‘টালি নালা’ হয়ে।
আরও পড়তে পারেন….
“নদী সেতু হয়ে আছে আমাদের বন্ধুত্বে”
প্রাণের দোসর কালীগঙ্গা ।। সন্তোষ কুমার শীল
সুন্দরী সোমেশ্বরী ।। আব্দুস সামাদ নয়ন
নদী রক্ষা আন্দোলন কর্মী, কলকাতা, ভারত।