অফুরান কথা আর প্রাণোচ্ছ্বলতা আমার স্বভাবসিদ্ধ বলে বাংলার মাষ্টারমশাই আমার নাম দিয়েছিলেন স্রোতস্বিনী। নদীর সম্পর্কে আমার প্রাথমিক আগ্রহ তৈরী হয়েছিলো বাবার দরাজ গলায় শোনা গান শুনে শুনে….
ও নদীরে একটি কথা-ই শুধাই শুধু তোমারে, আমায় ডুবাইলি রে আমায় ভাসাইলি রে, এ নদী এমন নদী, জল চাই একটু যদি দুহাত ভ’রে উষ্ণ বালুই দেয় আমাকে ! দুর্বোধ্যতার এক অদ্ভূত রহস্য ঘনীভূত হতো মনের মধ্যে নদীকে ঘিরে।
শ্রদ্ধেয় সমরেশ মজুমদার লিখেছিলেন- “যে নদীর সঙ্গে শৈশব জড়িয়ে থাকে, যে নদীকে একসময় প্রায় বন্ধুর মতো মনে হয়, তার জন্যে যে ভালোবাসা তা আজন্ম থেকে যায়”। হয়তো তাই..
কলকাতার সাথে নাড়ির টান, তাই হয়তো স্বাভাবিকভাবেই শরীর মন জুড়ে গঙ্গা প্রবাহিত। টাঙন, আত্রেয়ী, মহানন্দা, করলার সাথে বেশ কিছু শৈশব- স্মৃতি হয়তো আছে, মনের মধ্যে স্থান দিতে পারিনি এখনো। আমার প্রিয় নদী গঙ্গাকে জীবনের বিভিন্ন বাঁকে কাছে পেয়েছি, ছুটে গিয়েছি, তার অদৃশ্য কাঁধে মাথা রেখে মন জুরিয়েছে।সবান্ধবে বা যুগলে নদীর পারে বসে আড্ডা দিয়েছি, নৌকা বিহার করা, সন্ধ্যারতি দেখা, আন্তরিক আলাপচারিতা বা বিষাদের স্মৃতিও যেমন আছে, আবার ভীষণ মানসিক চাপে নদীর ধারে গিয়ে প্রাণ খুলে শ্বাস নিয়ে স্বস্তির আশ্বাস নিয়ে ফিরে এসেছি অনেকবার। আমার রাগ, বিরক্তি, গলে জল হয়ে যাওয়া, আহ্লাদীপনা, কষ্টে ভেঙে পড়া, উচ্ছ্বসিত হওয়া সব রকম আবেগের ঢেউ খেলে যাওয়ার মুহূর্তের সাক্ষী আমার গঙ্গা।
মনে পড়ে যাচ্ছে কলকাতা স্টেশন থেকে তেভাগা এক্সপ্রেসে তুলে দিতে আসতো বাবা, চোখের জল আড়াল করতে ফিরে তাকাতো না, আমার চোখের জল অনেক শাসনেও কিছুতেই বাঁধ মানতো না।যখন দক্ষিণেশ্বরের ব্রীজের ওপর দিয়ে ট্রেন ছুটতো, আমি নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকতাম গঙ্গার দিকে।আমার মনের ছায়া পড়তো গঙ্গায়! মনে হতো যেন ঘট নাড়িয়ে দিয়েছে কেউ, দর্পন-বিসর্জন হয়ে গেলো.. নীলকন্ঠ পাখিটাও উড়ে গেছে কৈলাসে,
উমার মতো আমিও চলে যাচ্ছি ক্রমশ বহুদূরে..
বাবার অস্থিভস্ম ভাসানো সেও তো কাকতালীয়ভাবে সেই গঙ্গাতেই..
বুড়িগঙ্গা-ই বোধহয় বললো সবাই !
ভুলেই তো গেছিলাম, ভুলেই ছিলাম, আমার প্রিয় বন্ধু-নদী গঙ্গা। বাগবাজার ঘাট, দক্ষিণেশ্বর, প্রিন্সেপঘাট, আড়িয়াদহ, ব্যরাকপুর, চন্দননগর, চুঁচুড়া, ভদ্রেশ্বর, জগদ্দল, নৈহাটি, দশাশ্বমেধ ঘাট.. কত স্মৃতি ! সব ঐ শুকনো ফুল, মালার মতো ভেসে গেছে, মনেও রাখিনি। হৃদয়ের একূল, ওকূল দুকূল ভেসে যায় ঐ গঙ্গা,গঙ্গার শাখা প্রশাখা বরাবর।
গাঙ্গেয় বাতাস গায়ে মাখিনি বহুদিন। আপাতত: দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে খাল, বিল, পুকুর, ডোবা যখন যা পাই, সেই জলেই চোখের তৃষ্ণা মেটাই, মন ভিজিয়ে নিই.. পৃথিবীর সব নদী ভালো থাকুক, দূষণ যেন কোনো নদীর শ্বাসরোধ না করে। নদী তো এপারের বা ওপারের হয়না, নদী অপার। আমার বা অপরের বলে নয়, সবার নদী সুস্থ ও স্বচ্ছ থাকুক এটাই প্রতিদিনের প্রার্থণা।
ডা. শর্মিষ্ঠা কর : চিকিৎসক, লেখক। কুশমন্ডি, দক্ষিণ দিনাজপুর, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।