ও নদী বন্ধুয়ার খবর এনে-দে ।। বঙ্গ রাখাল

বন্ধুয়ার

নদীর কথা মনে আসলেই প্রথমে বাবার কথা মনে পড়ে। বাবা বলতেন, তোর দাদাজান ছিল একজন মাছুড়েরে মুনি। যেখানেই মাছ মারার কথা শোনতেন তিনি সেখানেই চলে যেতেন। বাবার মুখেই শুনেছিলাম আমাদের গ্রামের তিনজন মানুষ এক বজ্রপাতেই মারা গিয়েছিল সেটাও ছিল কোন এক নদীতে মাছ মারতে যাওয়ার ঘটনা।

আমার যতদূর মনে পড়ে, এটাই বুঝি নদীর সাথে পরিচিত হওয়ার প্রথম সূত্র। আবার যখন দ্বিতীয় কি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি তখন কবিতা পড়তাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের-

আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।

যাক সে সব কথা। নদীর কথা শুনেছি এটাই বড় কথা। সেটা যেখান থেকে যেভাবেই শুনি না কেনো শুনেছি এটাই সত্য। আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কুমার নদী। এই নদীতে বন্ধুদের সাথে নৌকায় করে অনেক ঘুরেছি।

বিকাল হলেই আমরা নদীর ধারে আড্ডা আর ঘাটে বউদিদের স্নানরত শরীর দেখতাম কেমন করে ভেজা শাড়ি ল্যাপ্টে থাকে শরীরের সাথে। অনেক বালিকা মেয়েদের দেখেও আমরা চিৎকার চেচামেচি করতাম। নদীপথ ধরে যখন দূর থেকে মানুষ দূরে যেত কিংবা জেলেরা মাছ ধরে বেড়াতো এই যে বিচিত্র জীবন মানুষের এসব দেখে সত্যিই হতবাক হততাম। মানুষের জীবন এমনও হয়। একসময় এই নদীতে পূজা বিসর্জন দিতে দেখেছি। পুজার সময় ফুলহরির হিন্দুরা এই নদীতে তাদের দেবতাদের বিসর্জন দিয়ে সুচি হত। ব্রীজের উপর দাঁড়িয়ে আমরা দাদা-দিদিদের আড়তি দেখতাম।

এই নদীকে ঘিরে আমার অনেক স্মৃতি। নদীর তীরে যে শ্মশানটা রয়েছে সেখানে আমরা কত আড্ডা মেরেছি এবং বটের তলে বসে সিগ্রেটে ঠোঁট রেখে নিজের মাধুরী কিংবা স্বজনী ভাবী ভেবে স্বপ্ন দেখেছি। সময়ের সাথে সাথে জীবন কেমন যেন বদলে যায় আমাদের জানাবোঝার অজান্তেই। তবুও বদলের চশমা আমরা চোখে পরে বাঁচতে চাই। সেই নদীর তীরে আজ কলেজ হয়েছে।

এখন আর সেই মানুষের দূর থেকে দূরে যাওয়ার নৌকা নেই। যা আছে তা কয়েকটা তালের ডোঙ্গা। নদীর দুইকূল সংকীর্ণ হয়ে এসেছে। নদীতে জমে থাকে পটের স্তর। তবুও বাড়িতে গেলে ব্রীজের উপরে সেই বাল্যের দিদিদের শরীর দেখার মত দৃশ্য আর চোখে আটকায় না। একসময় বাবা-চাচাদের কাছে শুনেছি আবার নিজেরাও দেখেছি- গুড় রাখার জন্য নৌকায় করে লোকেরা দূর থেকে মাটির পাত্র নিয়ে আসত, যাকে আমরা কোলা বলতাম। এখনতো আখের চাষই নেই আর কোলা মানুষের বাড়ি হয়তো দু’একটা আছে ধানভিজিয়ে রাখার জন্য। আখের সেই খোলাগুলোও এখন আখের অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে।

আমার নদী নিয়ে গানগুলো সব সময়ই কেন এত হৃদয়ে দোলা দেয় জানি না হয়তো নদীর সাথে আমার আত্মীক একটা টান আছে। আমার প্রিয় গান-

নদীর এ কূল ভাঙে
ও কূল গড়ে
এই তো নদীর খেলা

অন্য একটি গান-

ও নদী বন্ধুয়ার খবর এনেদে
দেখিনা তারে কতদিন
জানি না কেমন আছে সে…

বাবা একটু গানপাগলা মানুষ ছিলেন। তার মুখেও কিছু নদীর গান শুনেছি। আজ লিখতে বসে নদীর অনেক স্মৃতি হৃদয়খোঁড়লে উঁকি মারে-

আমার গাঁয়ের চারিপাশে কত কত গাঁও
বিল-বিলান্তি নদী নালা মাঝিরা বায় নাও।

আবার গাইতো-

শানে বান্ধ্যা ঘাটে কন্যা
কলসিতে জল ভরে
কন্যার রুপে নদীর পানি
ঝলমল ঝলমল করে-রে।

কুমার নদীকে ঘিরে কত যে স্মৃতি আছে তা বলে শেষ করা যাবে না। আজ নদীর দিকে তাকালে হৃদয়ের মাঝে এক জটিল ব্যথা অনুভব করি। এখানে আজ জলঢেউ নেই, ধান্যঢেউ দোল খায় বাতাসে। আমাদের এ নদী যৌবনা হলে ভরে ফেঁপে ওঠে তার যৌবন তার সাথে আমাদের ও। কেন না দূরদূরান্তের মানুষেরা এর তীরে এসে বৈকালী খাবার খেয়ে শান্ত্ব হত যুবতী বালিকার হাত ধরে কিংবা পাশে বসে হাতে রেখে হাত। আজ সব হারাতে বসেছি…প্রিয় বালিকা তোমায়- প্রিয় নদী তোমায়। কেড়ে নিলে সবই- আমি এখন কোমায়। দূরের পানে আজ শুধু ধূ ধূ বালি চর।

কবে আবার শান্ত্ব হবে চোখ হে যৌবতী কুমার নদী তোমায় জলে ধূয়ে আমি হব সুচি। হারানো সময়, বন্ধু সবাইকে খুব মনে পড়ে। বাড়ি গেলেই নদীর দিকে তাকিয়ে বলি-তোর মনে পড়ে নদী, তোর জ্বলে ভাসতে ভাসতে আমার বন্ধুয়া অনেক দূরে ভেসে গিয়েছিল। সেদিনও আমার চোখে জল ছিল। কখন কীভাবে ফিরে আসবে সেই ভাবনায়। আজ আবার বলি-ও নদী আমার বন্ধুয়ার খবর এনে দে। আমি যে আমার বন্ধুয়াকে হারিয়ে ফেলেছি। তার জন্য মন পোড়ায়…


আরও পড়তে পারেন…..
আমার শৈশব নদী ।। হামিদ কায়সার
হালদা নদীকে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ ঘোষণা: যৌক্তিকতা ও বিশ্লেষণ

সংশ্লিষ্ট বিষয়