আমার নদী মধুমতী ।। রুখসানা কাজল

মধুমতী

প্রায় চল্লিশ বছর আগের ঘটনা। রাগে দুঃখে অপমানে অভিমানে জন্মশহর থেকে শিকড় তুলে নিয়েছিল আমাদের পরিবার। কী যে মায়াবী সুন্দর ছিল শহরটি। শহরের গা ছুঁয়ে বয়ে যেত সাদা জলের এক নদী। যারা বয়স্ক তারা বলতেন, মরা মধুমতী। শান্ত শ্রীময়ী ধীর ছন্দের মধুমতী দুকূলে অজস্র শণবনের ঝোপঝাড় নিয়ে আমাদের জীবনের সাথে মিশে ছিল। ভোরে, সকাল, দুপুর বিকেল সন্ধ্যা এমনকি রাতেও বাপী,মা, দিভাই, আপুলিদের সাথে নদীপাড়ে ঘুরতে গিয়ে কতবার দেখেছি এ নদীকে। কুয়াশার দোপাট্টা পরে ধীরে ধীরে বয়ে যাচ্ছে ভোরের নদী। তার সাদা বুকে জলতরঙ্গের অনুচ্চ সুরের গুনগুনানি। নদীপাড়ের ঘাসেরা হাত পা…

কালী নদী, যেখানে ঋণী আমার শৈশব ।। মাসুম মাহমুদ

শৈশব

নদী ভরা কূলে কূলে, ক্ষেত ভরা ধান আমি ভাবিতেছি বসে কী গাহিব গান। কেতকী জলের ধারে ফুটিয়াছে ঝোপে-ঝাড়ে, নিরাকুল ফুলভারে বকুল-বাগান কানায় কানায় পূর্ণ আমার পরাণ। -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখন ওই নদীর কাছে গেলে মনে হয় মায়ের মুখের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। তার স্বচ্ছ জলের চোখ আমায় দেখে যেন বলছেন, ‘কিমুন আছো, বাবা?’ বলছি কালী নদীর কথা। বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব-বাজিতপুর সীমানা হয়ে প্রিয় কুলিয়ারচরে প্রবেশ করে ভৈরবের মানিকদীর নিকটে শেষ হওয়া একটি নদী। আমার শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের অনেকটা সময় কালী নদীর সাথে কেটেছে। ছোটবেলায় ওই নদীটার সাথে আম্মাই আমাকে পরিচয়…

আহা, এইখানে এক নদী ছিল… ।। প্রভাষ আমিন

প্রভাষ

সবারই শেষ জীবন কাটানোর একটা স্বপ্ন থাকে। কারো স্বপ্ন পূরণ হয়, কারোটা হয় না। আমার স্বপ্নটা ছোট, কিন্তু জানি পূরণ হবে না। আহা, আমার যদি ছোট্ট একটা নদীর পারে ছোট্ট একটা কুঁড়েঘর থাকত। সেখানে ফেসবুক দরকার নেই, ইন্টারনেট লাগবে না; খালি বই পড়া আর গান শোনার ব্যবস্থা থাকলেই হবে। সকালে নদীর পারে হাঁটব, বুক ভরে নেব, ফ্রেশ অক্সিজেন, দুপুরে নদীতে সাঁতার কাটব, বিকেলে নদীর পারে আরাম কেদারায় বসে বই পড়ব আর গান শুনব। রাতে নদী থেকে আসা ভেজা হাওয়া গায়ে মেখে, বাতাসে ভেসে আসা ফুলের গন্ধে ঘুমিয়ে যাব। আমার শেষ…

কচানদী: নদীও নারীর মতো ।। মনি হায়দার

কচানদী

এই পদ্মা, এই মেঘনা, এই যমুনা সুরমা নদী তটে আমার রাখাল মন গান গেয়ে যায় এ আমার দেশ, এ আমার প্রেম আনন্দ বেদনায় মিলন বিরহ সংকটে কত আনন্দ বেদনায় মিলন বিরহ সংকটে এই মধুমতী ধানসিঁড়ি নদীর তীরে নিজেকে হারিয়ে যেন পাই ফিরে ফিরে এক নীল ঢেউ কবিতার প্রচ্ছদপটে এই পদ্মা এই মেঘনা এই হাজার নদীর অববাহিকায় এখানে রমণীগুলো নদীর মতো, নদীও নারীর মতো কথা কয় এই অবারিত সবুজের প্রান্ত ছুয়ে নির্ভয় নীলাকাশ রয়েছে নুয়ে যেন হৃদয়ের ভালোবাসা হৃদয়ে ফোটে গানটির গীতিকার আবু জাফর। আবু জাফরের মনস্বী চৈতণ্যে অনেক সুরেলা ও…

বুকের ভিতর একটা নদী ।। রাজু বিশ্বাস

বুকের

আমার প্রথম প্রেমিকা ইছামতি। তার বুকের উপর আমার বসবাস। আমার ঘরের উঠোন জুড়ে আছে সে। আমার প্রাণের উপকূল জুড়ে তার প্রবাহমানতা। তার কোল ছেড়ে আমি বেশি দিন অন্য কোথাও গিয়ে থাকতে পারি না। সে আমার বাল্যকালের সখা; যৌবনের প্রেয়সী। আমি যতই বলবো তার কথা ততই কম বলা হবে। আমার গ্রামের নাম বাজিতপুর। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র নায়িকা কুসুমের বাপের বাড়ি ছিল বাজিতপুর। কিন্তু সেই গ্রাম আর আমার গ্রাম এক না হলেও এ গ্রামের পথে আমি কুসুমকে খুঁজে পাই। সে আজো শশী দাদাবাবুর উদাসীন প্রেমে আকুল হয়ে কেঁদে চলে সারারাত।…

আমার শৈশবের তুরাগ এখন অর্ধমৃত! ।। মোহাম্মাদ এজাজ

তুরাগ

দেশের অনেক নদীই আজ তার ঐতিহাসিক নাম হারিয়ে যেন এক নামে উপনীত হয়েছে- সেটি হলো ‘মরা নদী!’ একটি নদী মরে গেলে শুধু নদীই মরে না, তাকে ঘিরে গড়ে ওঠা জনসংস্কৃতিও মরে যায়! জনসাধারণের জীবিকা নির্বাহের প্রতিবন্ধকতা, নদীমাতৃক এলাকায় মরুকরণ, জীববৈচিত্র্যের বিপন্নতাসহ নানা সমস্যা দেখা দেয়। দেশের সেই সব মরণাপন্ন নদীর একটি তুরাগ। দখল, ভরাট আর দূষণে ‘নিখোঁজ’ হতে চলেছে তুরাগ নামের এই নদটি। এটিই  আমার শৈশব ও কৈশোরের কহর দরিয়া। শৈশবে এই তুরাগই আমার উচ্ছলতা ও চঞ্চলতার নেপথ্যে ছিল। এটিই আমার ভালবাসার নদ। প্রিয় তুরাগ, আদালতের রায়ে জীবন্তসত্তা তুরাগ।  আমার…

যে জলে জীবন জ্বলে ।। রেজাউল করিম

জীবন

ছেলেবেলা থেকেই নদী ও প্রকৃতির সাথে আমার জীবন জড়িয়ে আছে আষ্টেপৃষ্ঠে। নদী ও প্রকৃতির শান্ত-সৌম্য-স্নিগ্ধ রূপ মাধুর্য দেখে যেমন মুগ্ধ ও বিমোহিত হয়েছি তেমনি এর রুদ্র রূপ, ঝঞ্জা-বিক্ষুব্দ ভয়ংকর নিষ্ঠুরতা দেখে হয়েছি অস্থির, কখনোবা বেদনায় নীল। প্রবল ঢেউ ও ঝরো হাওয়ায় কখনো বা বিপন্নবোধ করেছি মেঘনা, পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার মাঝনদীতে। উত্তাল ঝড়ো হাওয়ায় ডুবে মরার হাত থেকেও দু’একবার প্রাণে বেঁচে ফিরেছি! আমার বেড়ে ওঠা খাল-বিল-নদী-নালা বিধৌত গ্রামীণ জনপদে। আশৈশব বিচরণ করেছি অনাবিল ও স্নিগ্ধ প্রকৃতির মাঝে। নানা ধরনের দেশীয় নৌকা, লঞ্চ, স্পীডবোট, স্টীমারসহ নানান ধরনের জলযানে চড়ে নদীপথে ভ্রমণ করেছি…

জলকাটার শব্দ শুনি ।। সত্যজিৎ রায় মজুমদার

জলকাটার

মায়ের পরে খুব রাগ হচ্ছে। ভীষণ ঘুম পাচ্ছে কিন্তু ঘুমাতে পারছি না। মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে শুয়ে আছি তবু মনে হচ্ছে নৌকায় শোয়া আর একটা দোলা লাগছে। মা, আমি ঘুমাতে পারছি না! ঢুল লাগছে। মা এটাকে উপেক্ষা করছে। এবার চিৎকার করে কান্না জড়ানো সুরে জানালাম। মা তবু হাসছে- ওরে পাগল, সারাদিন নৌকায় শুয়ে থেকে ঢুল লেগেছে। শুয়ে পড়, একটু পর ঠিক হয়ে যাবে। টাবুরে করে মামাবাড়ি থেকে বাড়ি এসেছি। বিকালে একটু শুয়েছিলাম। আমাদের বাড়ি মোংলা পোর্ট থেকে পূর্ব দিকে তিন কি.মি. কাইনমারী গ্রামে। মামাবাড়ি একই জেলা বাগেরহাটের রামপাল থানার মালীডাঙ্গা গ্রাম।…

আমার ছেলেবেলার বড়নদী ।। মু আ লতিফ

বড়নদী

আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমার একটা বড়নদী ছিলো। এখন আমি বড় হয়েছি, এখন সেই নদী ছোট হতে হতে প্রায় মিলিয়ে গেছে। আমি কোনোভাবেই আমার ছেলেবেলার নদীর সাথে একে মিলাতে পারি না। আমার মন ভারাক্রান্ত হয়, আমি বড় কষ্ট পাই। আথচ ছেলেবেলায় এই নদীই ছিলো আমার ভালোবাসা। আমার শৈশব-কৈশর নদীর জল, জলের নিরবধি বয়েচলা, বর্ষায় টই-টম্বুর স্রােতধারার সাথে মিশে ছিলো। শুধু কী তাই- আমার শরীর-মন ও আমার চৈতন্যকে বিকশিত করেছিলো আমার প্রিয় ভালোবাসার এই নদী। আমার জন্মভিটা থেকে তিন’শ গজ দূরেই ছিলো সেই নদী। সেই নদীতে সাঁতার কাটা, বন্ধুদের নিয়ে…

আমলাচাতর গ্রামের ভুজুং মাঝি ও অজয় নদীর পাথর ।। দিবাকর দাস

আমলাচাতর

সে অনেক বছর আগের কথা, ভুজুং তখন জোয়ান। তার বাড়ি ছিল আমলাডিহি গ্রামে (বর্তমান নাম আমলাদহি)। এখন যেখানে চিত্তরঞ্জন রেল শহরের চব্বিশ নম্বর (নামের) স্কুলটা আছে তার পাশে। তার বাড়ির দাওয়ায় একটা কাঁঠাল গাছ ছিল। পূর্ব দিকে অনেকটা নিচু জায়গা। বর্ষাকালে সেখানেই মাছ ধরত তারা ছোটো বেলায়। এখন সে টাঙ্গির এক কোপে শ্যাওড়া গাছ কাটে। একদিন গাঁয়ে নেমে এল শোকের ছায়া। তাদের ভিটে ছেড়ে চলে যেতে হবে। সেখানে নাকি শহুরে বাবুদের জন্য থাকার বাড়ি হবে। ভুজুং বুঝতে পারে না, তাদের কেন বাড়ি ছেড়ে যেতে হবে। এত ট্যাঁড় জমি। বানাক না…

রাইন আমার প্রিয় নদী : যেমন আত্রেয়ী আর আন্ধারমানিক ।। তুহিন শুভ্র মন্ডল

রাইন

যে নদীর পারে আমার জন্ম, সেই আত্রেয়ী তো আমার প্রিয় হবেই। আমার মন-প্রাণ তাতে জুড়ে থাকবেই নদীর জলে সাথে মাছের মতো। কিন্ত যে নদী আমি দেখিনি কোনও দিন সে নদী? সে নদীও তো প্রিয় হতে পারে। যেমন রাইন। তাকে যে মনশ্চক্ষে দেখেছি অনেকবার। শিরা উপশিরায় প্রবাহিত তার জলের ছন্দ। আর আন্ধারমানিক? তাকে দেখেছি একটা বৃষ্টি ঝিরঝির মায়াবী সকালে। সূর্যের আলো যার জলে হয়তো আমারই পূর্বপুরুষের ছবি এঁকে রেখেছিল। তাই তার কথা এত মনে হয়। ঢাকার সদরঘাটে বুড়িগঙ্গা থেকে এম ভি, সুন্দরবন লঞ্চে নদী সমূহের জলে ভাসতে ভাসতে,  জলের হাওয়ায় মন…

এই মৃত নদী আমার তিস্তা না ।। শুভময় পাল

মৃত নদী

‘ছলাৎ ছল ছলাৎ ছল ছলাৎ ছল ঘাটের কাছে গল্প করে নদীর জল’ না, আমার তিস্তা এমন নদী না; গল্প সে করে, তবে সে গল্প নামনাজানা পাহাড়ি ঝরনার, সে গল্প প্রায় ভুলে যাওয়া আদিম জনজাতির। সে গল্প দুরন্ত, চঞ্চল, উচ্ছল। আমার তিস্তা অভিমানী, বেপরোয়া। শীতের বেলায় প্রায় মরা সোঁতা, বর্ষাকালে উপচে পড়া তাথৈথৈ। আমার বাড়ি তিস্তার পারে ছিল বললে খুব ভুল বলা হবে না। জলপাইগুড়ির হাকিমপাড়া, সরু একটেরে গলিতে প্রায় শেষে এক ভাড়া বাড়ি। বাঁশের ছেঁচার বেড়া, লঙ্কা জবার গাছ, এগোলে তপনদের খাটাল আর বিষ্ণুদা’দের বাড়ি। নীল অপরাজিতা ফুটে থরে থরে।…