।। দীপাঞ্জন দে ।।
অঞ্জনা হলো আমাদের রাজ্যের প্রাচীন নদীমাতৃক জনপদ নদিয়া জেলার একটি মৃতপ্রায় নদী। অঞ্জনাকে খাল বলেও অনেকে অভিহিত করে থাকেন। যাইহোক, আমরা এই নিবন্ধে সেই বিতর্কে না গিয়ে অঞ্জনা বাঁচানোর আন্দোলন সম্পর্কে কিছু কথা জেনে নেব। নদিয়া-মুর্শিদাবাদের অন্যতম প্রধান নদী জলঙ্গির ধারা থেকেই অঞ্জনার সৃষ্টি। আর অঞ্জনা মিশেছে চূর্ণী নদীতে গিয়ে। জলঙ্গির শাখা নদী হলেও, অঞ্জনার সাথে জলঙ্গির যোগসূত্রতা ছিন্ন হয়েছে অনেক আগেই। জেলা সদর কৃষ্ণনগর হলো অঞ্জনার জন্মস্থান। কিন্তু সেখানে আজ অঞ্জনা পুরোপুরি মৃত। কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে অঞ্জনার খাত প্রত্যক্ষ করা যায় বটে, কিন্তু সেখানে অঞ্জনা আর নদী নেই, নালায় পরিণত হয়েছে। এই অঞ্জনাই একদা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রমণপথ হয়েছিল।
আর আজ সেই অঞ্জনার বুকে আস্ত একটা শহর গড়ে উঠেছে। কৃষ্ণনগর ক্যাথিড্রালের সম্মুখে অঞ্জনা খালের প্রায় মজে যাওয়া একটি অংশ আজও দেখতে পাওয়া যায়। ফি-বছর কৃষ্ণনগরে চার্চের আড়ম্বরপূর্ণ মেলা শেষ হলে দেখা যায় অঞ্জনার সেই খাত আবর্জনায় পরিপূর্ণ। এই জায়গাটির ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথা আমাদের অনেকেরই হয়তো জানা নেই। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ ‘সিস্টার্স অফ চ্যারিটি’-র পক্ষ থেকে প্রথম চারজন ইতালীয় মিশনারী অঞ্জনার তীরে ঠিক এই পবিত্র স্থানটিতেই নৌকা থেকে অবতরণ করেছিলেন। কৃষ্ণনগরের ইতিহাসে মিশনারীদের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
অঞ্জনা সংস্কারের দাবি অনেক আগেই উত্থাপিত হয়েছে। কিন্তু খুব বেশি পরিকল্পিত আকারে না হওয়ায় সেই আন্দোলন দানা বাঁধেনি। ১৯৫১ সালে নদিয়া জেলার তদানীন্তন ম্যাজিস্ট্রেট মণীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় নাকি অঞ্জনার সংস্কারে উদ্যোগী হয়েছিলেন। যদিও তার কোনও ইতিবাচক ফল মেলেনি। ২০০৬ সালে নদিয়া জেলা পরিষদের উদ্যোগে শহরের দক্ষিণে অঞ্জনার কিছুটা সংস্কার হয়েছিল। তারপর ২০০৮ সালে তৎকালীন বিধায়কের এলাকা উন্নয়ন তহবিল থেকে অঞ্জনার সামান্য সংস্কার হয়েছিল। তাও অধরা থাকে। কৃষ্ণনগর পৌরসভাও বিভিন্ন সময় অঞ্জনা সংস্কারে হাত লাগিয়েছে, কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন সময় এগিয়ে আসা হয়েছে। ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে ‘কিশোর বাহিনী’ সংগঠনের উদ্যোগে অঞ্জনা বাঁচানোর দাবি নিয়ে পথে নামা হয়েছিল। নদীপাড়ের মানুষেরা সেটি চাক্ষুষ করেছিলেন। অতি সম্প্রতি আরেকটি সংস্থা ‘সমাজ শুদ্ধি দর্পণ সোসাইটি’ শহরের নিকাশি ব্যবস্থার অন্যতম মাধ্যম অঞ্জনা খাল সংস্কারের দাবি জানিয়ে পথসভা ও প্রচার কর্মসূচি চালায়। স্থানীয় বিদ্যালয় ও সেখানকার ছাত্র ছাত্রীদেরও সময়ে সময়ে অঞ্জনার বিষয়ে কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করতে দেখা গিয়েছে।
অবস্থার পরিবর্তন না হলে শীঘ্রই অঞ্জনার অস্তিত্ব পুরোপুরি বিলুপ্ত হবে। অঞ্জনা সংস্কারের দাবি জানিয়ে কৃষ্ণনগরের পরিবেশ সংগঠন জলঙ্গি নদী সমাজকে ২০২২ সালের শুরুতে একটি সাইকেল মিছিল করতে দেখা যায়। অঞ্জনার বিলুপ্ত, লুপ্তপ্রায় এবং আংশিক জীবিত নদীখাত অনুসরণ করে তারা এবং তাদের বন্ধু সংগঠনের পরিবেশকর্মীরা ২ জানুয়ারি, ২০২২ প্রায় ১৮ কিলোমিটার সাইকেল মিছিল করেন। সেদিনের যাত্রাপথটি ছিল এইরূপ— কৃষ্ণনগর স্টেডিয়াম থেকে হাটবোয়ালিয়া এবং সেখান থেকে কৃষ্ণনগরের হেড পোস্ট অফিস মোড়। সমগ্র যাত্রাপথে সাইকেল আরোহীরা অঞ্জনাকে দখলমুক্ত এবং সংস্কারের স্বপক্ষে প্রচারাভিযান চালান। বেজিখালি, শক্তিনগরের পাঁচমাথা মোড়, দোগাছির অঞ্জনা ব্রিজ, হাটবোয়ালিয়া গ্রামের অঞ্জনার তীরে বিশেষ করে সচেতনতামূলক প্রচার চালানো হয়।
সাইকেল-আরোহী পরিবেশ কর্মীরা জনগণকে সচেতন করতে তাদের হাতে, গলায় একাধিক প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে প্রচার কর্মসূচী সারেন, সেগুলির কোনওটিতে লেখা— “মুক্ত হবে নদী গর্জে উঠি যদি”, আবার কোনওটিতে লেখা— “তোমার আমার পথ চলা নদীর জন্য কথা বলা”, “জলঙ্গি, চূর্ণী, অঞ্জনা তোমার আমার ঠিকানা”। মোটকথা এই পরিবেশকর্মীরা সেদিন যে দাবিতে পথে নেমেছিলেন, সেটি হলো— বেআইনিভাবে নদী, খাল, ডোবা বা যেকোনও ধরনের জলাভূমির দখলদারি করা আর চলবে না। সাইকেল মিছিলের শেষ গন্তব্য ছিল কৃষ্ণনগরের হেড পোস্ট অফিস মোড়, সেখানে পৌঁছে পরিবেশকর্মীরা পথসভার মাধ্যমে পথচলতি মানুষদের অঞ্জনার দাবিতে একত্রিত হওয়ার আহ্বান জানান এবং বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে আসা পরিবেশকর্মীরা জনগণের সামনে অঞ্জনা সম্পর্কিত নিজেদের বক্তব্য রাখেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, অঞ্জনার একটি বিক্ষিপ্ত অংশ হিসেবে পরিচিত চালতেতলা খাল বুজিয়ে ফেলার বিরুদ্ধেও সেদিন পরিবেশকর্মীরা সরব হন। শুধু তাই নয়, আগামীদিনে এইরকম জলাভূমি বেআইনিভাবে দখল করার বিরুদ্ধে তারা আরও জোরদার আন্দোলনে সামিল হওয়ার আহ্বান জানান।
লেখক: পরিবেশকর্মী, নদিয়া, পশ্চিমবঙ্গ। ও সম্পাদক, পরিবেশ পত্রিকা ‘জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা বার্তা’ (ত্রৈমাসিক)।
আরও পড়ুন…
সুরাইয়া খানমের কবিতা : ও ঘূর্ণি ও জলোচ্ছ্বাস