প্রায় চল্লিশ বছর আগের ঘটনা। রাগে দুঃখে অপমানে অভিমানে জন্মশহর থেকে শিকড় তুলে নিয়েছিল আমাদের পরিবার। কী যে মায়াবী সুন্দর ছিল শহরটি। শহরের গা ছুঁয়ে বয়ে যেত সাদা জলের এক নদী। যারা বয়স্ক তারা বলতেন, মরা মধুমতী। শান্ত শ্রীময়ী ধীর ছন্দের মধুমতী দুকূলে অজস্র শণবনের ঝোপঝাড় নিয়ে আমাদের জীবনের সাথে মিশে ছিল।
ভোরে, সকাল, দুপুর বিকেল সন্ধ্যা এমনকি রাতেও বাপী,মা, দিভাই, আপুলিদের সাথে নদীপাড়ে ঘুরতে গিয়ে কতবার দেখেছি এ নদীকে। কুয়াশার দোপাট্টা পরে ধীরে ধীরে বয়ে যাচ্ছে ভোরের নদী। তার সাদা বুকে জলতরঙ্গের অনুচ্চ সুরের গুনগুনানি। নদীপাড়ের ঘাসেরা হাত পা ছড়িয়ে কথা বলছে জলের সাথে। শরবনে ডাহুক ডাকছে। এরকম পটভূমিতে দূরের নৌকাগুলোকে ছবির মত লাগত। কে যেন চারকোল দিয়ে এঁকে গেছে নদীর বুকে। স্থির। অচল। নিথর। কুয়াসার আদর মাখা ধুসর কালো কালো নৌকা সিরিজ।
দূর থেকে ভেসে আসত কোনো গান। সে গানের গায়ককে দেখা যেত না। সে থাকত জলের আড়ালে। জলের ঠোঁটে চুমু খেয়ে সেই সুর ছুঁয়ে যেত ভোরের মোমআলো। নদী তখন কাছে ডাকত, আয় না তোরা, একটু জড়িয়ে ধরি তোদের। ধল দুপুরে মধুমতীর বুক জুড়ে থাকত জ্যামিতি। সে এক জলের ব্লাকবোর্ড। তাতে বিদায়ী সূর্য আলো ফেলে ত্রিভুজ, কখনও চতুর্ভুজ এঁকে দিতো। মুহুর্ত মাত্র সেগুলো হয়ে যেত বৃত্ত। নদীও জ্যামিতি জানে.. খুশিতে চেঁচিয়ে উঠতাম!
মধুমতী এমন ছিল না। অতি ভয়ঙ্কর ছিল আগে। বর্ষায় দুকূল ছাপিয়ে ঘরবাড়ি ডুবিয়ে ফসল ভাসিয়ে খলখল করে বয়ে যেত। বান ডাকত যখন তখন। কেড়ে নিত চরে থাকা গরু বাছুর ছাগলের পাল। বাগে পেলে মানুষেরও রেহাই ছিল না। আমাদের ফার্মেসির পাশে বুড়ো দুর্যোধন দাদুর কবিরাজি দোকান। সারাক্ষণ মউমউ সুগন্ধ খেলে বেড়াত দোকানে। মহারাক্ষসের মত লাল টুকটুকে পান খাওয়া ঠোঁট আর জিভ নেড়ে দাদু পুরনো নদীর গল্প শোনাত। আমরা শিউরে উঠতাম। মাঝে মাঝে আকরাম, রেন্টু, সুনুদা অবিশ্বাসে হেসে উঠত, এ নদীতে কুমির ছিল ! কাঙ্গট, হাঙ্গরও? বান ডাকত? দাদু যে কি পরিমাণে বানানটিং মারে তাহা কহতব্য নয়। অই বলদিরা, তোরা শোন। আমরা গেলাম।
আমাদের তখন ত্রাহি অবস্থা। গল্পও শুনতে ইচ্ছে করছে। আবার ওদের সাথে বনবাদাড় চষে বেড়াতে মন চাইছে। দাদুকে ছেড়ে ওদের সাথে বেরিয়ে পড়তাম।চৌরঙ্গী পেরিয়ে চলেআসতাম কলেজঘাট। ফ্যাটফেটে পেস্ট রঙ্গের উপর লাল বর্ডার দেওয়া কতগুলো লঞ্চ ভিড়ে আছে। কোনটা থেকে ভেঁপু বাজাচ্ছে সারেং। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে যাত্রী উঠছে। সবাই উপরে বসতে চাইত। খালাসি্রা তাই চেষ্টা করত যাত্রীদের নীচে বসাতে। নিত্য দিনের যাত্রী এরা। ছাত্র। হাটুরে। অফিসকর্মী। কাছেই কোন গ্রামের ঘাটে অথবা অঘাটে নেমে যেত ।পরদিন আবার ফিরে আসত।
কোনকালের একটি কাঠের পোতাশ্রয় ছিল। সেটি ভেঙ্গে চুরেগেছে। তাছাড়া নদীও ছোট হয়ে চলে গেছেবহুদূর।রোগা চেহারার ভাসমান নারীরা ঘুরে বেড়াত সেখানে। টিনের মগ নিয়ে চায়ের দোকানে এসে অদ্ভুত দেহভঙ্গি করত। ওদের দেখিয়ে আখআঁটির উপর বসে সুনুদা চোখ মারত, দেখ মনে হয় ছারপোকা কামড়াচ্ছে।
কলেজ ঘাটের বাঁদিকে গেলে সোনাকোড়, পাচুরিয়া, গোবরা, মানিকদহ। ডানদিকে গেলে ভেড়ারহাট, বলাকড়, বোলতোল। আমরা এ পর্যন্ত চিনতাম। যদিও জানতাম, আরও অনেক ঘাট আছে। মাঝে মাঝে লঞ্চে চড়ে এসব চেনাজানা ঘাটে ভেসে যেতাম।
ছোট শহর।একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের চিহ্ন লেগে আছে সব জায়গায়। রোজ দুপুরে আমরা ঘুরতে বেরোতাম। আমাদের বাবাচাচাদের সবাই চেনে। অনেকেই জানত আমরা কাদের ছেলেমেয়ে। শুধু আমাকে কেউ বুঝতে পারত না আমি ডাক্তার সাহেবের ছেলে নাকি মেয়ে। আমার বাটিছাঁট ছোট চুল, জামাপ্যান্ট দেখে অনেকেই ছেলে ভাবত। এ নিয়ে কোন মাথা ব্যথা ছিল না । তবেএকটা অসুবিধা হত। অনেক সময় খেয়া নৌকার অপেক্ষায় না থেকে ছেলেরা জামাপ্যান্টগেঞ্জি খুলে মাথায় বেঁধে দিব্যি সাঁতার কেটে ওপারে চলে যেত। আমি তদ্দিন লজ্জা ব্যাপারটা জেনে গেছি। তাই খেয়া নৌকার অপেক্ষা করতাম।
ওপারের কূল জুড়ে আঠালো মাটি। আমরা বলতাম , ‘ভেড়ভেড়ে কেদা’। সেই কাদা পেরুলেই চর। অসংখ্য শণবন। বিকেল হলেই ঝাঁপিয়ে ডাক দিত প্রান্তরের রক্তপলাশ, শিমূল, কৃষ্ণচূড়ার গাছ। আমরা অবাক হয়ে দেখতাম মধুমতী নদীর সব রঙ তুলে নিয়ে আকাশ কেমন গাছের মাথায় ছবি হয়ে ঝুলে আছে।
মাঝে মাঝে শুশুক দেখতে চলে যেতাম মানিকদহ। মধুমতি সেখানে বিশাল ঢেউ তুলে জোলো গলায় হা হা করে ডাকত। বাতাস থাকত ভিজে আর ঠান্ডা। দূরে নীল ঢেলে দিয়েছে আকাশ। এত নীল! হাত ডুবালে যেন নীলরঙে মেখে যাবে হাত। কয়েকটা নৌকাভেন্নাপাতার মত দুলে চলে যাত।হঠাৎ করে অনেকগুলো রূপালি শুশুক মাথা তুলে ভুঁস করে ডুবে যেত। আকরাম তখন গম্ভীর হয়ে বলত, দাদু মনে কয় ঠিকই বলিছে রে। চল চল। তাড়াতাড়ি পালাই। কুমিরটুমির আসি পড়তি পারে। শালারা নাকি হাঁটতিও পারে।
ভয়ে তাড়াতাড়ি ছুটে আসতাম কাছাকাছি কোন ঘাটে। সেখানে পাঁপড় আর লালজিলেপি কিনে অপেক্ষা করতাম শহরের দিকে যাওয়ালঞ্চের জন্যে। লঞ্চের ছাদে বসেও আমাদের বিস্ময় কাটত না। এই যে ওড়নার মত চওড়া সাদা মরা মধুমতী সত্যি এত সাংঘাতিক ছিল!
অথচ প্রতিদিন দুপুরে ছেলেরা লঞ্চের ছাদ থেকে ডাইভ দিচ্ছে। কম্পিটিশন দিয়ে এপারওপার করছি। হিন্দু সম্প্রদায়ের মাসি পিসী কাকিমারা স্নান করছে। পূজার ফুল ভাসিয়ে দিচ্ছে। বাপী আমাকে আর ভাইয়াকে মাঝে মাঝে ভোরে তুলে নিয়ে আসত। কি যে কষ্ট হত তখন। বাপি নামাজ পড়ত আর আমরা মসজিদের দেওয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমাতাম। কিন্তু নদীর কাছে নিয়ে এলেই ঘুম চলে যেত। তখন দেখেছি, কেউ কেউ সূর্য প্রণাম করছে।
দু একজন গ্রাম্য সাদাসিধে লোক আমাদের সাথে বসে পুরনো মধুমতীর গল্প শোনাত। সেই যে এক জোতদার, মেয়ের বিয়েতে মধুমতীর ভেড়ভেড়ে কাদায় নতুন জামাইয়ের জামাকাপড় জুতা নষ্ট হবে বলে গোলার ধান ঢেলে রাস্তা করে দিয়েছিল। কত বজরা ডুবে গেছে মধুমতীর চরে। উন্মত্ত ঘূর্ণিগুলো কত মানুষকে টেনে নিয়ে গেছে গহন জলের অতল তলে। এক কৃষক ধান কাটার কাঁচি দেখিয়ে আমাদের বলেছিল, বর্ষাকালে নাকি এরচে বেশি ধারালো হয়ে যেত মধুমতীর স্রোত। আঙ্গুল ডুবালে ভয় লাগত, স্রোতের ধারে যদি কেটে যায়! ব্রিটিশ আমলে ষ্টীমার চলত। কত মানুষ কলকাতা যেতো। বর্ষায় প্লাবিত মধুমতী পলিমাটির সাথে পুকুর বিলে অসংখ্য মাছ ফেলে যেত। ইলিশ, বড় রুই, পাঙ্গাস, মৃগেল, আইড়, বোয়ালের সাথে কই, টেংরা, রয়না, সরপুঁটিসহ কত মাছ।
বর্ণির বিলের কথা শুনিছ তুমরা? সেখেনে কত মাছ। কত পদ্মফুল। জোছনা রাতে পরিরা খেলে বেড়ায় অই বিলে।
আমাদের একঘর আত্মীয় আছে বর্ণি গ্রামে।বড়দের কাছে শুনেছি, মুক্তিযুদ্ধের আগে গয়না নৌকাতে চড়ে অনেকেই বেড়াতে গিয়েছিল অই বাড়ি। বাপি গান ধরেছিল, বেলা বয়ে যায় মধুমতী গায়, ওরে মন ছুটে চল—- তাছাড়া আবুল হাসান নামে এক প্রেমিক কবির ঠিকানা ছিল অইবর্ণি গ্রামে। খুব সুখি ছিলাম আমরা আমাদের ছোট মধুমতী নিয়ে।
কিন্তু সুখ ত শৈশবের মত। দ্রুত ফুরিয়ে যায়। সেই যে যুদ্ধ হয়েছিল একাত্তরে। মুক্তিযুদ্ধ। মধুমতীর নদী লাল হয়ে গেছিল মানুষের রক্তে। বাপি স্বাধীনতার স্বপক্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কাজ করেছিল। তারপর কি যে হল, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের অরাজকতা নিয়ে প্রতিবাদ করায় বাপীকে তীব্র সমালোচনা করতে শুরু করল উঠতি রাজনীতিবিদরা। বাপীর ধর্মনিরপেক্ষতাকে কটাক্ষ করে বিভিন্ন মহলের যড়যন্ত্র প্রকাশ্যে আসতে লাগল। ফার্মেসির ক্রেতা নেই বললেই চলে। ফসলি জমি আর বসতবাড়ির অনেক অংশ বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছিল। এরকম এক সন্ধ্যায় বন্ধুদের সাথে ঘুরেফিরে বাসায় এসে জানতে পারলাম আমদের এ শহর থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে রাজধানীতে। বাসা ভাড়া হয়ে গেছে। স্বজন যখন কুজন হয়ে যায় তখন দূরে চলে যাওয়াই শুভ সিদ্ধান্ত।
রাতের লঞ্চ পানি কেটে ভটভট শব্দ করে এগুচ্ছে। প্রিয় শহর, প্রিয় নদী, খেলার সাথী আর মা-বাপীকে ছেড়ে আমরা চলে যাচ্ছি। সার সার আলোর মালার প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে মধুমতীর জলে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে নদী। সংকীর্ণ বুকের উপর দিয়ে লঞ্চ চলছে সাবধানে। আমার বাপীর অপমানে মধুমতী যেন চাইছে নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে।
সেদিন প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, এ শহরের থেকে নাড়ি উপড়ে নিলাম আমরা। আর কখনও ফিরে আসব না। অন্যেরা ফেরেনি। চল্লিশ বছর পর এক আমন্ত্রণে আমি ফিরে গিয়েছিলাম। অচেনা শহর। নদী নেই। প্রান্তর মুছে গেছে।বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল তরুণ নদীর কথা শুনে জানিয়েছিল, এই যে এই রাস্তার নীচে ছিল বলে শুনেছি। মধুমতী। আপনি কি করে জানলেন ম্যাম?
বৈশাখী আল্পনায় আঁকা পাকা রাস্তাটি দেখে আমি হেসে বলেছিলাম, গুগলে জেনেছি রে।
রুখসানা কাজল, কথাসাহিত্যিক, নর্থ ধানমন্ডি, ঢাকা।