টাঙ্গনের সঙ্গে আমার সম্পর্ক মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্কের মতো। টাঙ্গন আমাকে শিখিয়েছে মানব জগতের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত জীবজগৎকে ভালোবাসতে। টাঙ্গন আমার অন্তরের ক্ষুদ্রতাকে দুইহাতে সন্তর্পনে আলগোছে সরিয়েছে। মনের দৈন্যতা, সংকীর্ণতা, হীনমন্যতা ঝেড়ে ফেলে জীবনযুদ্ধে কীভাবে অনমনীয় মনোভাব নিয়ে মোহনার দিকে এগিয়ে যেতে হয় তার পাঠ আমি টাঙ্গনের কোলে বসে নিয়েছি।
টাঙ্গন নামক অখ্যাত নদীটি তার সমস্ত সত্তা দিয়ে চেষ্টা করে যায় আজও রাইখোরের জোগান দিয়ে আমাদের রসনাকে আর মৎসজীবীদের আর্থিক দিককে তৃপ্ত করতে। দারিদ্র্যতা তার আলুথালু বেশ ও বারিহীন রুক্ষকেশ দেখে একনজরেই ঠাহর করা গেলেও তা নিয়ে তার নেই কোনও হীনমন্যতা। বরং দারিদ্র্যকেই সে তার জীবনের অহংকার, তার গরিমা হিসেবে বরণ করেছে।
টাঙ্গনকে একবার তার স্নেহতীরে বসে জিজ্ঞেস করেছিলাম ‘টাঙ্গন তোমার গতিপথকে অবরুদ্ধ করে দিচ্ছে যে মানবজাতি, তোমার গভীরতাকে বুজিয়ে দিচ্ছে যে স্বার্থপর মানুষ তুমি তাদের শাপ দেবে না ?’ টাঙ্গন জবাব দিয়েছিল ‘ক্ষমাশীলতাই প্রত্যেকের পরম ধর্ম হওয়া উচিত। মানুষকে নিজে থেকেই উপলব্ধি করতে দাও যে তারা কী ভুল করছে।’ জীবনের পাঠ নিতে এইজন্যেই বারবার ফিরে ফিরে আসতে হয় টাঙ্গনের কাছে।
টাঙ্গন ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সৌভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক বজায় রেখেছে সুদৃঢ়ভাবে। এটি বাংলদেশ ও ভারতের আন্তঃসীমান্ত নদী । বাংলাদেশের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুর জেলা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নদীটি ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মালদা জেলায় প্রবেশ করেছে। মালদা জেলার গাজোল ও বামনগোলা থানার সীমানা নির্ধারণ করে আইহোর কাছে মহানন্দা নদীতে মিশে গেছে। এই নদীর অববাহিকায় গড়ে উঠেছে টাঙ্গন ব্যারাজ সেচ প্রকল্প, ঠাকুরগাঁও শহর রক্ষা প্রকল্প এবং বুড়িবাঁধ সেচ প্রকল্প।
টাঙ্গন শুধু একটি নদী নয়, তা সভ্যতার উত্থান-পতনের সাক্ষী ও অভিজ্ঞান। যে লোকায়ত জীবন আজও যাপন করে চলেছে গ্রামীণ মানুষ, তার সঙ্গে রয়েছে প্রাণের ও আত্মার সম্পর্ক টাঙ্গনের। আজও টাঙ্গনের দুই তীরে মেঠোসুরে বাজে রাখালের বাঁশি, বসে খন গানের আসর। কত জীব বৈচিত্রের আশ্রয় যে এই টাঙ্গন তার ইয়ত্তা নেই। কত কৃষকের ফসলের প্রাচুর্যের যে মূল উৎস টাঙ্গন, কত জলপুত্রদের জীবিকার প্রধান অবলম্বন যে টাঙ্গন; তার হিসেব আমরা রাখি না। কিন্তু তবু অকৃতজ্ঞ মানুষ কলুষিত করছে এই মাতৃসম নদীকে। যার ছায়ায়, স্নেহে, ফলে মানুষ তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে তাকেই সাবালক হয়ে কুঠার হস্তে কর্তন করতে মানুষের মতো শ্রেয় জীব এই বসুন্ধরায় আর কেই বা আছে। তাই তো দিনের পর দিন অকাতরে চলে টাঙ্গনের বুক নিংড়ে অপরিকল্পিতভাবে বালি তোলা, চলে টাঙ্গনের গতিপথকে বাঁশজাল দিয়ে অবরুদ্ধ করে সুতি দিয়ে নৃশংসভাবে বাস্তুতন্ত্র বিঘ্নিত করে মাছ ধরা।
তবু টাঙ্গন মুখ বুজে সব সয়ে যায়। ধরিত্রী মাতার মতো সেও যে সর্বংসহা হয়ে গেছে। মানুষের অপরিমিত লালসার প্রত্যহ শিকার এখন তাকে হতে হয়। যন্ত্রদানবের কল্যাণে অহংকারী মানুষের যথেচ্ছাচারী হয়ে টাঙ্গনের রক্তমাংস খুবলে নেওয়া এখন তার সুনির্দিষ্ট নিয়তি। তাই তো একটু বৃষ্টি হলেই নাব্যতা কমে যাওয়া এই নদী দুইকূলে গড়ে ওঠা মানুষের শৌখিন বাড়িগুলোতে, কৃষির জমিগুলিতে উঁকি মারতে প্রবল বেগে ধাবমান হয় । সব আত্মসাৎ করে নিতে ইচ্ছে হয় তখন টাঙ্গনের । কিন্তু নিঃস্ব মানুষের রিক্তকান্না দেখে তার বুক ব্যথায় টনটন করে ওঠে। সে তো আর মানুষের মতো ক্রূর নয়। মানুষের অসহায়তা তাকে কাঁদায়, মানুষের হাহাকার তাকে ভাবায়। কিন্তু মানুষ কি তাকে নিয়ে ভাবে ? মানুষ তো আজ বধির ও অন্ধ হয়ে গেছে! কিন্তু সময় এসেছে নিজেদের সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখতে, উত্তরাধিকারদের একটি সুন্দর স্বাস্থ্যকর পৃথিবী উপহার দিতে, আমাদের প্রিয় টাঙ্গন নদীকে নিয়ে ভাববার।
টাঙ্গনের উৎপত্তি নিয়ে এই অঞ্চলেএকটি সুন্দর লোককাহিনী প্ৰচলিত আছে। একবার শৈশবে পার্বতী নাচতে নাচতে পুণ্ড্রদেশে চলে এসেছিলেন। হঠাৎ তিনি নাচ থামিয়ে খেয়াল করেন যে এক অজানা দেশে তিনি পৌঁছে গেছেন। তখন ভয় পেয়ে পার্বতী কাঁদতে শুরু করেন। এইসময় বলি নামক ভয়ঙ্কর দৈত্য পার্বতীকে দেখতে পেয়ে দয়াপরবশ হয়ে তাকে পার্বতীর পিতা দক্ষের কাছে পৌঁছে দেন । দক্ষ খুশি হয়ে বলিকে তার কাঙ্ক্ষিত বর প্রদান করতে চাইলে বলি বলেন ‘ আপনার মেয়ের মতো টংকন করতে করতে যাবে আমাদের অঞ্চল হয়ে একটি নদী, এমন বর দিন।’ সেই টংকন শব্দ থেকে টাঙ্গন শব্দের সৃষ্টি। আর সেই থেকে এই অঞ্চলে টাঙ্গন নদীর প্রবাহধারা অব্যাহত।
‘সবার ওপরে মানুষ নয়, নদী সত্য’ –হয়ে উঠুক আমাদের বচন। এটিই হোক একবিংশ শতাব্দীর দৃপ্ত শ্লোগান। তবেই হয়ত আমরা পারব বাস্তুতন্ত্র বজায় রেখে, সুপার সাইক্লোন, সুনামি, বিশ্ব উষ্ণায়নকে বিদায় জানিয়ে নিরুদ্বিগ্নভাবে জীবন যাপন করতে।
ড. অমর কুমার পাল : লেখক, শিক্ষক, বুনিয়াদপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।