নীহারিকা আফরোজ ইঞ্জিন বোট থেকে পদ্মার কোলে ঢলে থাকা বিকেল দেখে অবাক হয়ে যায়। জমাট হলুদ পাকা চালতারঙের আকাশ। নদী আমোদিত করে আকাশের টকটক ঘ্রাণ ভেসে আসছে। প্রিন্টেড ওড়নার নেকাব খুলে মনে মনে ভাবে নীহারিকা, ইস্যি রে! একটুখানি নুনঝাল পেলে কি যে মজা হত এখন ! চটাস করে একটুখানি টক আকাশ ভেঙ্গে চটকেমটকে চেটেখাওয়া যেত!
কাল্পনিক লোভ সামলে নদী দেখে নীহারিকা। পদ্মা এখানে বেশ শান্ত। কেমন শান্তি শান্তি হয়ে বয়ে যাচ্ছে অজস্র জলরাশি। পাশ থেকে চলে যাওয়া ইঞ্জিন বোটের ছুটেআসা ঢেউ ছাড়া পদ্মার কোনো অস্বাভাবিক নড়চড় নেই। ভাঁজে ভাঁজে একই ভঙ্গিতে খেলে যাচ্ছে নরম আদুরে স্রোতমঞ্জরী। মখমল কোমল পানি হেসে গলে ঢেউয়ের মাথায় ঝিলিক চিলিক মুক্তো ছড়াচ্ছে যখন তখন
দূরে পদ্মার কূল ছুঁয়ে কালু পরদাদার মাজারের মত ছায়া ফেলে আছে অজস্র কাশবন। মেঘেরাও ছায়া দিচ্ছে। নিঝুম আলোর নিবিড় মায়ায় ছায়ারা সেখানে মোহময় জলঘর বানিয়ে নিয়েছে। মেঘেরাও তবে ছায়া দেয়!
অবাক হয় নীহারিকা আফরোজ।এই পৃথিবীর জন্য এত মায়া অই আকাশের! এত এত ভালোবাসা এই মায়াবতী মেঘদের! আর তাদের নদী কীর্তিনাশা?
নীহারিকা জানে, এই পদ্মাই তাদের কীর্তিনাশা! গ্রাম মুলফতগঞ্জ, উপজেলা নড়িয়া, জেলা শরীয়তপুরের নদী নন্দিনী! কি ভয়ানক চতুরা, ছলনাময়ী সেই নদী! ছলিবলি মুখ ঢেকে বয়ে গেছে গ্রামের পর গ্রাম। যেনো ভাঙন কি, নদী কীর্তিনাশা জানেই না সে তান্ডবের কথা!
অথচ তলে তলে মাটি খেয়ে এগিয়ে এসেছে জনপদের একেবারে হৃৎপিণ্ডের ভেতর। এখন ভাঙছে। ঘর, গোহাল, ফসলি জমি, ইশকুল কলেজ শ্মশান গোরস্তান। রেহাই দিচ্ছে না কাউকে। গিলে গিলে খাচ্ছে সবকিছু। ভাঙ্গনের ধাক্কায় অতি দ্রুত তলিয়ে যাচ্ছে একেকটা গ্রাম। বিস্মিত হতবাক গ্রামবাসি পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে কেবল জল আর জল। বিমল আনন্দে ছুটে আসছে। কোথায় তাদের সেই শান্ত নদীটি!
দুই.
দু’হাত খুলে মুঠো দেখে নীহারিকা। দড়ির দাগ মুছে গেছে তালু থেকে। কিন্তু চোখে ভাসছে কিরণমালার ভয় ভরা দুটি চোখ! কীর্তিনাশার ভাঙ্গনে জলের তোড়ে ভেসে যাওয়ার আগে মরণ চিৎকার করে উঠেছিল কিরণমালা। ভাঙ্গনের শব্দ ছাপিয়ে সে চিৎকার শুনে বুক কেঁপে উঠেছিল ওদের। তবু ওরা কেউ থামেনি।
থামতে পারেনি। পায়ের নিচ থেকে যে কোন মুহুর্তে ধ্বসে যাচ্ছে মাটি। সেই ধ্বসের গভীর থেকে খলবলিয়ে ছুটে আসছে রাশি রাশি জল রাক্ষুসি। আর মাটি ভেঙ্গে পড়ছে বিশাল বিশাল আকারে। ধেয়ে আসা সেই ভাঙ্গনের ভয়ে সবাই তখন উৎপীড়িত, দিশেহারা পাগলপ্রায়। প্রাণ হাতে কেবল ছুটছে। ছুটছে শক্ত কোন স্থল মাটির খোঁজে।
গেল কয়েকদিন ধরে ওদের ঘাড়ের পেছনে খলবল করে ডাকছিল নদী। বর্ষা শেষে টান পড়েছে নদীর জলে। সেই টানে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। শত শত জলের হাত বাড়িয়ে নদী কীর্তিনাশা ভেঙ্গে নিচ্ছে মানুষের ঘরবাড়ি, জমিজিরেত, শস্যক্ষেত, মসজিদ, মন্দির, মাজার, শশ্মান, কবরখানা। রেহাই পায়নি, ইশকুলকলেজ,হাসপাতাল, এতিমখানা, হাটবাজার, খেলার মাঠ কৃষকের প্রাণপ্রিয় বীজঘর। পেট পুরতে আরো আরো মাটি চাই যে রাক্ষুসি কীর্তিনাশার! জলের থাবায় যখন তখন ভেঙ্গে চুরে ভাসিয়ে নিয়ে পেটের গহনে পুরে নিচ্ছে সবকিছু।
এক দুপুরে ভাঙ্গনের তীব্রতা নীহারিকাদের বাড়িসংলগ্ন জমি ছুঁয়ে ফেলতেই ওরা ছুটে বেরিয়ে পড়েছিল। হাতের কাছে যা পেয়েছে তাই সম্বল। ওরা দু ভাইবোন টেনে নিয়ে ছুটছিল কিরণমালার ছেলে রুস্তমকে। ওদের পেছনে ছিল কিরণমালা। হঠাত মাটি ধ্বসে খলখলিয়ে লাফিয়ে আসে অগাধ পানির ঘূর্ণি। সেই ঘূর্ণিতে ভেসে যাওয়ার আগে মরণ চিৎকার দিয়েছিল কিরণমালা। সেই ডাক শুনে এক পলকের জন্যে ওরা দেখতে পেয়েছিল ডুবন্ত কিরণমালাকে। চার পায়ের দৌঁড় খানিকটা থামিয়ে শেষবারের মত রুস্তমও দেখেছিল ওর মাকে। ছোট্ট বুকটা খালি করে বিপন্ন চরাচর কাঁদিয়ে ছুটন্ত বাছুরটি ডেকে উঠেছিল, হাম্বাআ আ আ আ —
ছুটে আসা পানির স্পর্শে চলকে ওঠে বুকের রক্ত। কোলের উপর রাখা জামাকাপড় আর বইএ ভরা ইশকুল ব্যাগটাজড়িয়ে ধরে নীহারিকা।নিঃশ্বাসে বেরিয়ে আসে অস্ফুট ভেজাশ্বাস, মা আ আআ —
কাল থেকে ক্লাশে বাংলা শিক্ষক রাবেয়া মিস রোল নম্বর এক ডেকে থেমে যাবেন। আশুরার ছুটির পর বেগম রোকেয়া সাখায়াত হোসেনকে নিয়ে লেখা রচনা জমা দেওয়া হলো না নীহারিকার। জেলা শরীয়তপু্র, উপজেলা নড়িয়ার মুলফৎগঞ্জ বালিকা বিদ্যালয়ের ক্লাশ এইটের ছাত্রী নীহারিকা আফরোজ ঢাকা চলে গেছে কাজের সন্ধানে।
রাবেয়া মিসের চোখ ভিজে যাবে জলে। মেয়েটা বড় ভালো ছাত্রী ছিল। একাগ্র আর মনোযোগ ছিল পড়াশুনায়। শিক্ষকরা আশা রেখেছিল প্রিয় ছাত্রীটির উপর। সে আশা কেড়ে নিয়ে গেছে নদী। নীহারিকারা এখন ভূমিহীন, উদ্বাস্তু, পরাশ্রয়ী সর্বহারা। কোন রকমে পেটে ভাতে বেঁচে থাকার জন্যে যে যেখানে পারছে ছুটে যাচ্ছে কাজের সন্ধানে। পরিবারের একে অপরের বাঁচা এবং বাঁচানোই যে এ মুহুর্তে সবচেয়ে বেশি জরুরী।
তিন.
নদী ভাঙ্গনে ইশকুল ভেসে যাওয়ায় কালুপরদাদার মাজারের পাশে প্রথমে অস্থায়ী ইশকুল করেছিলেন ওদের প্রধান শিক্ষক শরাফত মন্ডল। সে মাজারও ভেসে গেছে পানির তোড়ে। ইশকুল নিয়ে গ্রামের আরো ভেতর সরে এসেছিলেন তিনি। যেনো নদী কীর্তিনাশার সাথে পাল্লা ছিল একরোখা শরাফত মাষ্টারের। ইশকুল সে করবেই করবে। কিন্তু নিত্য দিনের ভাঙ্গনে সবকিছু উজাড় হয়ে যাওয়া গৃহস্থের কাছে ইশকুল তখন বাতিল ব্যাপার। তবু ছেলেমেয়েরা পড়তে আসত। উন্মুক্ত আকাশ। বিশাল বিশাল গাছ। তার ছায়ার নিচে ইশকুল বসিয়েছিলেন তিনি। পাশেই পাকা রাস্তা। রাস্তার ওপারে উপজেলা সরকারী হাসপাতাল। তার পাশে পল্লি উন্নয়ন অফিস। শরাফত মাষ্টারের ধারণা ছিল, নদী বুঝি এতদূর পথ আসবে না ! আসতে পারবে না !
কিন্তু জলের চোখে কীর্তিনাশা ঠিকই চিনে নিয়েছিল পথ। শরাফত মাষ্টারের সমস্ত ধারণাকে ভাসিয়ে দিয়ে হাসপাতালসুদ্ধ পল্লি উন্নয়ন অফিস পর্যন্ত ভাঙ্গনের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল নদী। তবে এবার কিছুটা সময় দিয়েছিল। কিছু দিন থমকে ছিল এক জায়গায়। সেও মাত্র কয়েকদিনের জন্য। এরপর দুমড়ে মুচড়ে হা হা করে তলিয়ে দিয়েছিল সমস্ত পাকা স্থাপনা। দু’একটি স্থাপনা কীর্তিনাশার অথৈ বুক থেকে হাঁসফাঁস করে শেষ বারের মত ভেসে উঠতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু গহীন গভীর বুকের অতলে সেগুলোকেও ডুবিয়ে নিয়ে গেছিল রাক্ষুসী কীর্তিনাশা।
এবার ভয় পেয়েছিলেন শরাফত মন্ডল। কিন্তু তিনি ত মোটেও থেমে থাকার মানুষ নন। দুচোখে জ্ঞানের তৃষ্ণা আর মনের অসীম শক্তিতে আবার ছুটে ছুটে শিক্ষক আর ছাত্রছাত্রীদের খুঁজে বের করেছেন মানুষটা। রুদ্র নদীর মতই রুদ্র মানুষ তিনি। স্বচক্ষে অনেকেই দেখেছে, অবাধ্য দুষ্টু ছাত্রছাত্রীকে লাঠি ঘুরিয়ে যেমন ভয় দেখান, সেভাবে নদী কীর্তিনাশাকে তিনি শাসন করেছেন নরম কঠিন শব্দ বাণে,আয় আয় ! আয় রে ক্ষেপি। ওরে ও হতচ্ছাড়ি ছুটে এসে কিছু ক্ষণ বোস না আমার পাশে! বলত মা কীর্তিনাশা, ভাঙ্গন ছাড়া তুই আর কি কি জানিস ! হতভাগী, পানিমুখি ধ্বংস যজ্ঞের মহারাণী, তুই কি জানিস মানুষের সাথে মানুষ যোগ হলে তার যোগফল কী হয়?
ছাত্রছাত্রীদের উন্মুক্ত ক্লাশের পাশেই খুঁটে গেঁড়ে রাখা হয়ছিল পোষা গরুছাগলের পাল। বলে দেওয়া ছিল সবাইকে, তেমন তেমন বুঝলে নিজেদের বাঁচানোর সাথে যেন পশুগুলোকে খুঁটে খুলে ছেড়ে দেয়। ভাগ্যে থাকলে ওরাও বাঁচুক। কালু পরদাদার মাজারের সাথে সে ইশকুলও গিলে খেয়েছে কীর্তিনাশা। সেখানে এখন হাততালি দিয়ে বয়ে যাচ্ছে নদী।
শরাফত মন্ডল জিকার গাছের লাঠি হাতে ঘুরে বেড়ান নদী কীর্তিনাশার ভঙ্গুর পাড় ধরে। বাতাসে তার ময়লা রঙ পাঞ্জাবি উড়ে অভয় পতাকার মত। মাঝে মাঝে তিনি নদী কীর্তিনাশাকে ট্রান্সশ্লেসন করতে দেন, অংক শেখান, জ্যামিতির সূত্রগুলো এঁকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বুঝিয়ে দেন। কখনও আবার জানতে চান, আচ্ছা জলখুকি, “মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান”–এই লাইনগুলোর মর্মার্থ কি ভালো করে বুঝতে পেরেছিস তুই?
চার.
ঢাকার নাহার গার্মেন্টসের সুপার ভাইজার নীহারিকার বড়চাচীম্মা ঢাকা থেকে ছুটে এসেছিল গ্রামে। কিন্তু গ্রাম কোথায় ! থই থই পানি ভাসছে একূল ওকূল একাকার করে। সেই অগাধ পানিরাশির সামনে আছড়ে পড়ে কেঁদে ফেলেছিল বড়চাচিম্মা। খেয়ে না খেয়ে দিনরাত কাজ করে যা কিছু জমিয়েছিল তা দিয়ে একটুখানি জমিজমা, ক্ষেত খামার বাগান করে রেখেছিল ওরা।শেষ ভাবনা ছিল এক সময় ঢাকা থেকে তারা গ্রামে ফিরে আসবে। আরাম করে হাতপা ছড়িয়ে ঘুমুবে। হাঁটবে। উঠোনে মেলে দেবে লাউকুমড়ো নলা শিমের জাংলা। নাবি জমিতে করবে হরেক রকম মরসুমি ফুলের চাষ। পুকুরে মাছ, পানিতে হাঁস পালন করে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিবে।
স্বপ্নগুলোকে বুকে নিয়ে গেলো কুড়ি বছর আট ফুট বাই আট ফুটের এক রুমে স্বামী স্ত্রী কেন্নোর মত জীবন কাটিয়ে গেছে। তাই ছুটি পেলেই ছুটে আসত গ্রামে। শাল সেগুনের গাছ ছুঁয়ে দেখতে। আধপাকা ধানছড়ার সাথে বুকে বুক মিলিয়ে নিঃশ্বাস নিতো অতৃপ্ত সন্তানস্নেহে। আর ছিল নীহারিকা। সব স্বপ্নের সেরা স্বপ্ন ছিল নীহারিকাকে পড়াশুনা করিয়ে প্রতিষ্ঠিত করে দেওয়া। সব স্বপ্ন তলিয়ে গেছে কীর্তিনাশায়।কিচ্ছু নেই। লোলুপ পানিরাশির সাথে বাতাস খেলে যাচ্ছে নির্লজ্জ উল্লাসে। ক্রন্দনরত সেই সময় শরাফত মাষ্টারকে দেখে চমকে উঠেছিল নীহারিকার বড়চাচীম্মা, কে? কে? কে তিনি? অলৌকিক জাহাজ বুকে নিয়ে আশা জাগিয়ে চলেছেন ভাঙ্গন কপালী মানুষগুলোর মনে! কিন্তু কই তার জাহাজ? তবে কি আরও ভাঙ্গন আছে! ভাঙ্গতে ভাঙতে সমস্ত দেশটা যখন ডুবে যাবে অথৈ জলের সাগরে, তখন কি তিনি আসবেন তার অলৌকিক জাহাজ নিয়ে!
কান্না ছেড়ে বড়চাচিম্মা সেই থেকে শান্ত হয়ে গেছেন। কোথায় যেনো আশা স্বপ্নরা দুলে গেছে তার বুকে্র ভেতর, আবার হবে। আবার জমবে মেলা। পাড়ায় পাড়ায় বাঁশকঞ্চির বেঞ্চে বসে, মানুষ মানুষকে ডেকে আবার বলবে, ও মাদবর ভাই, ও আসগর ভাইজান হাটে যাচ্ছো নাকি এইবেলা? মিয়ার বেটারা আসো দেহি। একবার আসি আমাগের সাথি বসি যাও খানিক পহর!
কেউ কেউ তাদের ডাক শুনে একটু থামবে। কেউ আবার হাত দুলিয়ে, কাজ আছেরে ভাডি পরে আসবানি বলে চলে যাবে। বসে থাকা মানুষদের ভেতরের দাড়িমুখো কেউ তখন এগিয়ে গিয়ে থেমে থাকা মানুষটির কাছে গিয়ে ডাকবে, অত কি ভাবতি লাগিছ মিয়াভাই! ওসব ভাবনা টাবনা ছাড়ি চলি আসো ত দেহি ইখানে। বসো বসো। আমাগের পাশে আসি ইকটুখানি বসি যাও ভাইধন। এক কাপ আখাগুড়ের চা খায়ি গপসপ করি না হয় কিছু সুমায়! তা শুনিছ নাকি মিয়াভাই সারের দাম ফের কেমন চড়চড়ায়ে বাড়ি যাতিছে! এদিকে ধান বেচলি পান হয় না। তুমাগের কি খবর ? এবার কও দিনি তুমাগের গ্রামের কি অবস্থা!
পাঁচ.
স্বপ্ন সে ত স্বপ্নই। সব স্বপ্ন ভেঙ্গে নীহারিকাকে নিয়ে চলে আসতে হয়েছে এই অন্ধ কালা বদ্ধ ঢাকা শহরে। হলুদ ট্যাক্সি নিয়ে ঘাটে অপেক্ষা করছিল নীহারিকার বড়চাচা জালালউদ্দীন মাদবর। তিনি শ্লথ হাতে নীহারিকার মাথা ছুঁয়ে দেন পরম মমতায়। বড় সখ ছিল ভাইজিকে পড়াশুনা শেখানোর। কদিন ধরেই ভাবছিল এসএসসি পাশের পর জেলা শহরের কলেজে পড়তে পাঠাবে নীহারিকাকে। কম দামে একটি পুরোনধুরোন স্ক্রুটি কিনে দিবে। ঘরের খেয়ে মেয়েটা কলেজে যাবে আসবে। মেয়েটারও পড়াশুনোয় মাথা ছিল পরিস্কার। সখও ছিল। সে সখ মিটিয়ে দিলো সর্বনাশী কীর্তিনাশা। মুলফৎগঞ্জ বালিকা বিদ্যালয়ে নীহারিকা আফরোজ নামে ক্লাশ এইটে পড়া ছাত্রীটি আর ইশকুলে যেতে পারবে না। কাল থেকে সে গার্মেন্টসে ঢুকবে কাজ করতে। বইয়ের বদলে সুতো কাটবে গার্মেন্টসের ফ্লোরে বসে।এছাড়া আর কি করার ছিল তাদের!
দশ বছর আগেও একবার নদী ভাঙ্গনে ঘরবাড়ি ভেসে গেছিল গ্রামের অনেকের।ভাঙ্গন ওদের কপালের লিখন। পোষা গরু ছাগলের দড়ি খুলে দিয়েছিল গ্রামবাসীরা। বাঁচুক ওরা। মানুষ, গরু, ছাগল, মহিষ, হাঁস মুরগি্ পাখপাখালি যেযেভাবে পারে উড়ে ছুটে, দৌঁড়ে জান বাঁচাক। মুলফৎগঞ্জ মাদ্রাসার সিনিয়র বিজ্ঞান হুজুর মাটি শুঁকে, মাটিতে থাবড় দিয়ে, কান পেতে সমূহ বিপদ বুঝেশুনে বলেছিলেন, আর বেশি দেরি নাই। ওমানুষ যদি বাঁচতে চান তো আপনাদের পোষা পশুপাখিদেরও বাঁচতে দিন। মা জননীরা, বাবা সকলরা খুলে দিন ওদের গলার বাঁধন। আল্লাহর সৃষ্টি ওদেরও যে জান বাঁচানোর হক্ আছে এই ত্রিভুবনে।
স্পীড বোট থেকে নেমে জালালউদ্দিন চাচার গাড়ির ভেতরে চাপাচাপি করে বসে আছে ওরা। অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে চাচা। থেকে থেকে কাঁদছেও। নীহারিকার কান্না শোক বলে কিছু নেই। খরখর করছে চোখ। আশ্বিনের আকাশ থেকে টকটক গন্ধ ভেসে আসছে। কেমন আঠালো আর ঘামা ঘামা আকাশ। নীহারিকা দেখে সূর্য পাটে বসার আয়োজন করছে। রঙ বদলে ফেলেছে প্রকৃতি। লাল হয়ে উঠেছে আকাশের পশ্চিম দিক। আমেনাদাদির ডিমপাড়া মুরগির মত সেই লাল মেঘের উপর গুছিয়ে বসেছে সূর্য। কি যেন ট্রানশলেশনটা করাতেন ইংলিশ স্যার, দ্য সান ইজ —-
তীব্র ঝাঁকুনি খেয়ে থেমে যায় গাড়ি। বিশাল এক ট্রাক হলুদ লেজ দেখিয়ে সাঁ করে বেরিয়ে গেলো ওদের গাড়ি ছুঁয়ে। বড় চাচীম্মা ভাগ্যিস ধরে ফেলেছিল নীহারিকাকে। নইলে মাথা ঠুকে যেত নির্ঘাত। চলে যাওয়া ট্রাকের উদ্দেশ্যে অশ্রাব্য গালি দিয়ে আবার গাড়ি চালাতে শুরু করে জালালউদ্দীন চাচা।
কোরআন শরীফ পড়ার মত নরম আর সুরেলা সুরে বড়চাচিম্মা সবাইকে শুনিয়ে স্বামী জালালউদ্দীনকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, নদী ভাঙ্গনের মানুষ আমরা। এত ভেঙ্গে পড়লে কি চলে আমাগের ! শুনছেন ও নীহারিকার বড়আব্বা। গাড়িটা একটু সাবধানে চালান গো আপনি। আমাগের সবাইর যে বাঁচতি হবেনে!
রুখসানা কাজল, কথাসাহিত্যিক, নর্থ ধানমন্ডি, লেকসার্কাস, ঢাকা।