মহাদেব ও ইছামতীর গল্প ।। সুজয় চক্রবর্তী

মহাদেব

বছরকয়েক ধরে শীতের এই মরশুমে অহরহ এ দৃশ্য চোখে পড়ছে। নদীর ধারে পিকনিক। ইছামতীর এই জায়গাটা এখন মফস্বলের পিকনিক স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গাড়ি করে হুস হুস করে লোক আসছে দল বেঁধে। তারপর সারাদিন নাচা-গানা, খানাপিনা করে আবার সব হুস হুস করে বেরিয়ে যাচ্ছে। আজও বক্স বাজিয়ে একদল লোক পিকনিক করছে। জনাদশেকের দলটা এসেছে সকাল সকাল। এখন আড়াইটে বাজতে চললো। বড় ডেস্কিতে মাংস রান্না হচ্ছে। গন্ধ ছাড়ছে ভুর ভুর করে। পাশে বড় ঝুড়িতে ভাতের ফ্যান ঝরছে। খানিক তফাতেই ঘুর ঘুর করছে দু-একটা কুকুর।

নদীর ধারে যেদিন পিকনিকপার্টিরা আসে, সেদিন মহাদেবের খুব আনন্দ হয়। কিছু খেতে পাওয়ার আনন্দ। অন্য কোথাও আর যেতে হয় না। তবে সব দিন সমান যায় না। হাতের পাঁচটা আঙুলও সমান না, মহাদেব জানে। গত সপ্তাহে হাবড়া থেকে একদল এসেছিল। তাদের একজন তো মহাদেবকে ডেকে এনে রীতিমতো যত্ন করে খাওয়ালো! মাংস ভাত। শেষে রসগোল্লাও দিয়েছিল দু’পিস। মহাদেব পেটভরে খেয়েছিল সেদিন। অনেকে আবার দূর থেকে দেখলেই কুকুর, বেড়ালের মতো তাড়িয়ে দেয়, যেমন আজকে। মহাদেব কয়েকবার এক পা দু’পা করে পিকনিক স্পটে উঁকিঝুকি মেরেছে। কিন্তু প্রতিবারই কালো, মোটা মতো একটা লোক ওকে দেখে ডান্ডা উঁচিয়ে তেড়ে এসেছে। ভয়ে পালিয়েছে মহাদেব। অপেক্ষা করে থেকেছে গামবুল গাছটার নিচে। যদি কিছু পাওয়া যায়। কিন্তু জোটেনি কিছুই। উল্টে লোকটা বলেছে, ‘এদিকে আসলে ঠ্যাং ভেঙে দেবো।’ রাগ হয়েছে লোকটার উপর। দিবি না, দিবি না। এসব বলার কি দরকার! বড় অসহায় লেগেছে তার। চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে গিয়েছে।

এলাকায় ভবঘুরে হিসেবে পরিচিত মহাদেব। কেউ কেউ আবার ‘পাগল’ও বলে। কেননা এক কথা সে বার বার বলে। কিছু পেলে খায়, না পেলে না খেয়ে থাকে। আজ অনেক আশায় ছিল, ভালো কিছু পাওয়া যাবে। কিন্তু দিল না কেউ। যারা জানে, তারা জানে, মহাদেবদের বাড়ির অবস্থা ভালোই। বাবা-মা না থাকলেও দুই দাদা আছে তার। সমাজে তারা সব প্রতিষ্ঠিত। এক দাদা স্কুল মাস্টার, আরেক দাদা পোষ্ট অফিসে। প্রতিষ্ঠিত দাদাদের ‘ভবঘুরে ভাই’ থাকতে নেই। তাই মা মারা যাওয়ার পর ‘বাড়তি’ ঝামেলা বলে দুই দাদা-ই মহাদেবকে পাশ কাটিয়েছে, যেমন করে পাশ কাটিয়েছিল শ্যামলী। শ্যামলীর সঙ্গে মহাদেবের ভাব-ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল। জানতো অনেকেই। সম্পর্ক গড়িয়েওছিল অনেক দূর। কিন্তু বেকারদের প্রেম-ভালোবাসা বড়ই নড়বড়ে। ফলত, ব্রেক-আপ। সম্পর্কের কাট-আপ হওয়ার পর থেকেই না-কি মহাদেবের মাথাটা ‘খারাপ’ হয়ে গিয়েছে! মহাদেব পাশ দিয়ে গেলে এলাকার কিছু ডেঁপো ছেলে এখনও নিচু স্বরে বলে, ‘প্যার কা সাইড এফেক্ট’। তারপর এ ওর দিকে তাকিয়ে জোড়ে হেসে ওঠে। মহাদেব শুনলেও কিছু বলে না।

নিজের বলতে মহাদেবের এখন কেউ নেই, কিছুই নেই। সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় এদিকসেদিক ঘুরে বেড়ায়। সন্ধে হলে নদীর ধারে একলা বসে থাকে। সব সময় বিড়বিড় করে। দিনের সব খুঁটিনাটি খুলে বলে নদীকে। হালকা হয়। তখন সে আর নদী মুখোমুখি। নদী যেন চুপ করে তার কথা শোনে! আর রাত হলেই চৌধুরীদের দালানের বাইরে কাত হয়।

ঠান্ডাটা আজ জাঁকিয়ে বসেছে। কিন্তু এই শীতেও গায়ে জামা নেই মহাদেবের। ক’দিন আগেই চৌধুরী বাড়ির ছোট ছেলে মন্টু শীতে ওকে কাঁপতে দেখে একটা জামা দিয়েছিল। দু’-একদিন পরেছিল, তারপর আর পরেনি। পরনের লুঙিটাই দুই বগোলের নিচ দিয়ে এসে টাইট করে বুকের সামনে গিঁট বেঁধে রাখে। প্রায় সব সময়। মাথায় একরাশ উসকোখুসকো চুল। কত দিন স্নান করে না, কে জানে! আগে তো এই নদীতেই সকাল নেই, বিকেল নেই কোনও না কোনও সময় ডুবের পর ডুব দিতে দেখা গেছে তাকে। নদীর তখন ভরা যৌবন। খুব ছোট মহাদেব। মা’কে ধরে ধরে অল্প জলে হাত-পা নাড়তো। বেশি দূরে যেতে পারতো না। ভয় পেত। মাঝে মাঝে জল খেয়ে ফেলতো। ধীরে ধীরে কখন যেন আর সবার মতো সেও সাঁতার শিখে গেল। এরপর বটের ঝুরি ধরে ধরে লাফ দিয়ে পড়তো নদীর বুকে। বড়দের দেখাদেখি শুরু করতো ডুব সাঁতার, চিৎ সাঁতার দেওয়া। একা তো না। আরও কত বন্ধু ছিল! তাদের সবার নাম মহাদেবের এখন আর মনে নেই। তবে উৎপলের কথা মনে আছে। এখনও রাস্তায় দেখা হলে খবরাখবর নেয়। সেবার বৃষ্টি হল খুব। নদীর দু’পাড় ছাপিয়ে জল বয়ছিল হু হু করে। পাড় ভাঙছিল যখন তখন। একেবারে নদীর ধারে বাড়ি ছিল উৎপলদের। ওদের পাশাপাশি যাদের বাড়ি, সবারই কপালে সেদিন চিন্তার ভাঁজ। ওরা ভেবেছিল রাতটা কোনওরকমে কাটাতে পারলে সকাল হলেই চলে যাবে মতিগঞ্জের ত্রাণ শিবিরে। কিন্তু রাতটা আর কাটলো না। টালির চাল দেওয়া ঘরগুলো একে একে তলিয়ে গেল নদীর গর্ভে! একদম চোখের সামনে। ঠিক যেমন সিনেমায় দেখায়! সেই রাতেই ওরা সবাই আশ্রয় নিয়েছিল শ্মশানের কালী মন্দিরে। মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু হারিয়ে অসহায় ওর বাবার ছবি বেরিয়েছিল পরের পরের দিন খবরের কাগজে। আর মনে আছে হারু নন্দীর কথা। বাড়ির আসবাবপত্রগুলোর তখন কাটা ঘুড়ির মতো অবস্থা। যে পাবে তার। এরমধ্যেই হারু নন্দী প্রতিবারের মতো ঐ স্রোতে ঝাঁপ দিয়ে পড়লো জলে! প্রাণে ভয় ছিল না। কাদের একটা মিটসেফ না-কি যেন ভেসে যাচ্ছে তখন। অনেকটা সাঁতরে গিয়ে কব্জা করলো সেটা। তারপর পাড়ে উঠে এলো। এইজন্যই নদীতে বন্যা হলে হারুর খুব আনন্দ হত। সেবার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল অনেক। ত্রাণ পেল না বহু মানুষ। ক্ষোভে ফেটে পড়লো তারা। এরমধ্যেই ঘোলাজলে মাছ ধরলো কয়েকজন।

এখন বড় একটা কেউ নদীর ধারে আসেটাসে না। নদীর সেই চেনা মানুষগুলো এখন কেমন অচেনা হয়ে গেছে! দুপুরে নদীর পাড়ে শখের মাছ ধরতো সবাই। পাশাপাশি একসঙ্গে বসতো। সবাইকেই চিনতো মহাদেব। সবার হাতেই লম্বা লম্বা ছিপ। সেও বসেছে কয়েকবার। পাশে রাখা থাকতো আটা-ময়দা মাখা। দুই আঙুলে গোল গোল করে পাকিয়ে তা বর্শিতে গেঁথে জলে ফেলতো ছিপ। ফাৎনা ডুবে গেলেই মারতো টান। বর্শিতে গেঁথে থাকতো পুঁটি, খোলসে, চারাপোনা কত রকমের মাছ! শুধু তো শখের মাছ ধরা না, ভরা বর্ষায় ডিঙি-নৌকা করে মাছ ধরতো জেলেরাও। জেলে পাড়া থেকেই শুধু না, মাছ ধরতে আসতো বাবু পাড়ার অনেকেই। সন্ধের পর-পরেই রাতের খাওয়া সেরে নৌকা ভাসাতো গভীর স্রোতে, ইলিশের খোঁজে। নৌকার খোলে জমা করতো মাছ। সকালে বাজার বসতো পাড়ে। চলতো বেচাকেনা। সেসবের পাট চুকে গেছে কবে! এখন মাছ ধরতেও বড় একটা কাউকে দেখা যায় না।

সারাদিন কিছুই পেটে পড়েনি মহাদেবের। খিদেই জ্বলে যাচ্ছে পেট। অজান্তেই কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো চোখ দিয়ে। রোজকার মতো নদীর জলে হাত-পা ধুয়ে একটু জল খেয়ে নিল মহাদেব। তারপর পাড়েই বসে থাকলো আর পাঁচটা দিনের মতো। যেখানে কতদিন সে আর শ্যামলী দুজনে বসে থেকেছে। কত গল্প করেছে, খুনসুটি করেছে। সব জানে এই নদী। একবার শীতে পরিযায়ী পাখিরা ভিড় করেছিল নদীর ধারের গাছগুলোতে। দূর থেকে গাছগুলোর পাতাও চোখে পড়ছিল না। সাদা ধবধবে। মহাদেব বলেছিল শ্যামলীকে, ‘কি চমৎকার দৃশ্য, তাই না! ‘
—— হুঁ, মনে হচ্ছে হারিয়ে যায়।
—— কোথায়?
—— যেদিক দুচোখ যায়।
—— একা?
—— উহুঁ, দুজনেই। কথাটা বলেই চোখ বুজে ফেলেছি শ্যামলী। তারপর মহাদেবের বুকে মাথা রেখে বলেছিল, ‘নদী সাক্ষী, বলো, তুমি আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না।’ মহাদেব ঘাড় নেড়ে তাই-ই বলেছিল। কিন্তু সেই শ্যামলীই সেসব বেমালুম ভুলে গিয়ে ‘মোটা মানিব্যাগ’ দেখে সরে পড়লো আরেকজনের সঙ্গে। তারপর ঘরও বাঁধলো! নদীর দিকে একমনে তাকিয়ে আছে মহাদেব। মহাদেব বোঝে, নদীও ভালো নেই। নদীর এ বুকেও এসেছিল অনেকেই। তারা শুধু নদীকে ব্যবহার করেছে ইচ্ছেমতো। তারপর চলে গেছে যে যার কাজে।

শ্যামলী ছিল মহাদেবদের পাশের পাড়ার মেয়ে। কিন্তু পরিচয় ছিল না। তার সঙ্গে প্রথম আলাপ হয়েছিল নদীতে স্নান করতে গিয়েই। শ্যামলী দু’হাতে পানা সরিয়ে সরিয়ে, পাড়ে দাঁড়িয়েই রান্নার জল তুলছিল সেদিন। দূর থেকে দেখছিল মহাদেব। স্নান করবে সে। হঠাৎ-ই শ্যামলীর হাতের কলসিটা জলে পড়ে গিয়েছিল। মহাদেবকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো, ‘কলসিটা জলে পড়ে গেল, একটু দেখো না।’ মহাদেব যেন এই ‘নির্দেশে’র অপেক্ষাতেই ছিল। জলে নেমে ডুব দিয়ে তুলে নিয়ে আসলো কলসিটা। তখনই শ্যামলীর মুখে এক ঝলক হাসি দেখেছিল মহাদেব। সেই থেকে শুরু। তারপর কত দিন গিয়েছে চলে! কত কথা হয়েছে বোনা।

শ্যামলী এখন বউ হয়ে বান্ধবনগরে চলে গিয়েছে। একবার শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমায় মহাদেবের সঙ্গে দেখা হয়েছিল শ্যামলীর। বিয়ের ঠিক পর পরই। কথায় কথায় মহাদেব জেনেছিল, বাড়ির সবাইকে ছেড়ে চিরদিনের জন্য যেখানে সে চলে গেলো, সেখানে কোনও নদী নেই। পানা সরিয়ে সরিয়ে কলসিতে জল ভরে নিতে হয় না আর। কলসি জলে পড়ে যাওয়ারও ভয় নেই! মটরের ডাইরেক্ট জলেই রান্না-বান্না হয়। মহাদেব শুনেছিল সব। কিছু বলেনি। মহাদেব দেখে, ইছামতীতেও এখন আর কেউ জলটল নিতে আসে না। উল্টে কেউ বলে ‘মরা’ নদী। কেউ বলে মরা ‘খাল’। আগের মতো ঘাটে ঘাটে স্নান করার লোক নেই। ভিড় করে না পরিযায়ী পাখিরাও। নদীর গায়ে এখন ‘দুর্গন্ধ’। পাঁকে এখন মশার বাস। পাশ দিয়ে কেউ হেঁটে গেলে থুতু ফেলে যায়!

নদী এখন ‘বন্ধ্যা’। বন্ধ্যা নদীর খবর এখন আর কেউ রাখে না। একবার একজন এসেছিল। সবাই বলছিল সে না-কি ‘পরিবেশবিদ’। সে বেশ আবেগ দিয়ে নদীকে ‘ছুঁয়ে’ দেখলো। তারপর বললো, ‘যা দেখছি, সেই ইছামতী আর নেই। পলি পড়ে পড়ে গভীরতা গেছে কমে। গতিও নেই আগের মতো। কোথাও বা কচুরিপানায় ভরা। এখনই ড্রেজিং করিয়ে জলের গতি বাড়ানো দরকার। তবেই নদী বাঁচবে। আর নদী বাঁচলে আমরাও বাঁচবো। সরকার থেকে এর ব্যবস্থা করুক।’ নদীর পাড় ধরে সেদিন মিছিল হয়েছিল। পা মিলয়েছিল এলাকার অনেক গণ্যিমান্যি। সে চলে যাওয়ার পর পাড়ে বসলো সাইনবোর্ড। তাতে লেখা হল ‘নদী বাঁচলে আমরাও বাঁচবো। আসুন, সবাই মিলে নদী সাফাইয়ে অংশ নিই।’ একদিন দেখা গেল, এলাকার মানুষ দলবেঁধে এসে প্লাস্টিক, প্রতিমার কাঠামো, আবর্জনা সব জল থেকে তুলে তুলে পরিস্কার করতে লাগলো। নদীর পাড়ে জমা করলো সেসব। তারপর গাড়ি করে চলে গেল অন্যত্র। নদী যেন পুরনো চেহারায় ধরা দিয়েছিল। কিন্তু মাস ছয়েক পর আবার যা ছিল, তাই! এরমধ্যেই সরকার চেঞ্জ হল। অথচ এবার আর কোনও ‘পরিবেশবিদ’ এলো না! নদীকে ভালোবেসে এখন আর কেউই আসে না। যারা বক্স বাজিয়ে পিকনিক করতে আসে, যাওয়ার সময় তারাই নদীর জলে ফেলে যায় থার্মকলের এঁটো পাতা, প্লাস্টিকের গ্লাস, তরি-তরকারির খোসা, মদের বোতল আরও কত কি!

নদীর কষ্ট হয়। নদী কাঁদে। মহাদেবের কান্না শোনার জন্য নদী আছে। কিন্তু নদীর কান্না শোনার কেউ নেই!

সুজয় চক্রবর্তী: গল্পকার, দক্ষিণ দিনাজপুর, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।


আরও পড়তে পারেন….
মেঘনার পাড় কেটে চলছে অবৈধ বালু উত্তোলন : বন্ধের দাবি এলাকাবাসীর
বরাকর একটি নদীর নাম ।। অতনু রায়
রিভার বাংলা’র আয়োজনে অনলাইন বিতর্ক উৎসব শুরু

সংশ্লিষ্ট বিষয়