চট্টগ্রামের মিঠাছড়া খাল এখন শুধুই স্মৃতি

কাজী আলিম-উজ-জামান ও এইচ এম মনসুর আলী, হাটহাজারী (চট্টগ্রাম) থেকে >>

কোথাও সমতল ভূমির সঙ্গে একাকার। আবার কোথাও শীর্ণকায় প্রবাহিত। লোকালয়ের মধ্য দিয়ে ছুটে চলা খালটির নাম মিঠাছড়া খাল। উত্তর চট্টগ্রামের শস্যভান্ডারের প্রাণ বলা হতো খালটিকে।

কী ফলত না খালের দুই পাশের জনপদে? ইরি ধান ছাড়াও সবজির মধ্যে শসা, চিচিঙ্গা, ঢ্যাঁড়স, বরবটি, তিতকরলা, ধুন্দল, ঝিঙে ,বাঙি, তরমুজ—আরও কত কী! আজ সবই স্মৃতি। কৃষকেরা আজ কেউ শ্রমিক, কেউ দিনমজুর।

একদিকে সীতাকুণ্ড, আরেক দিকে হাটহাজারী, মাঝে সৌদিপুরা পাহাড় থেকে উৎপত্তি মিঠাছড়া খালের। খালটির অস্তিত্ব দেখতে হাটহাজারী বাসস্ট্যান্ড সামনে রেখে ১১ মাইল এলাকার শহীদ ওয়াহিদুল আলম সড়ক ধরে দেওয়াননগরের দিকে এগিয়ে যাই। ভাঙা ইট-কাদার রাস্তা। এরপর দোআঁশ মাটির পিচ্ছিল কাঁচা রাস্তা। শ্রাবণ মেঘের দিন। কিছুটা নিস্তব্ধ চরাচর। বিচ্ছিন্ন কিছু ফসলের খেত, পানের বরজ।

কিন্তু মিঠাছড়া কোথায়? এলাকাটি ঘুরে দেখার সহযাত্রী হলেন দেওয়াননগরের সিকদারবাড়ির বাসিন্দা ৬০ বছর বয়সী নূরে আলম। খেতখামার করেন। তিনি আঙুল তুলে দেখালেন, খালটি কোন স্থান থেকে এসে কোনদিকে গেছে। জানা গেল, খালটি উদ্ধারের জন্য এলাকাবাসীর দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন-সংগ্রামের কথা ‘কনে কুরি-ব-এ খাল, কে-হ-ত নাই দেখার’ অর্থাৎ নূরে আলম বলতে চাইছেন, এখন আর কেউ 
খাল উদ্ধার নিয়ে কথা বলছেন না। এখন আর দেখার কেউ নেই।

তবে দেওয়াননগরের একটি অংশে এখনো টিকে আছে খালটি। কুলকুল করে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে পাড় ভাঙছে। কারণ, গ্রামের অনেকেই জমির টপ সয়েল বা উপরিভাগের মাটি বেচে দিচ্ছেন। ফলে খালের দুই পাড়ের জমি ভেঙে পড়ছে। এখানকার বাসিন্দা ফয়সাল উদ্দিন জানালেন, তিনি প্রতি ঘনফুট মাটি বিক্রি করেছেন ৫ থেকে ১০ টাকায়।

ঘুরে দেখা গেল, বৃহদাকার দুটি ইটভাটা খালের অস্তিত্ব ধ্বংসের জন্য প্রধানত দায়ী। মেসার্স শাহজালাল ব্রিক ফিল্ড ও মেসার্স সোনালী ব্রিক ফিল্ড নামে এ ইটভাটা দুটির প্রতিষ্ঠা ’৯৭ ও ’৯৫ সালে। একটু একটু করে মাটি নিতে নিতে খালটি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। উত্তরা সিটি নামে একটি আবাসন প্রকল্পেও খালের জায়গা রয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর জানিয়েছে, দুটি ইটভাটাই পরিচালিত হচ্ছে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে।

আরো পড়ুন….

মৃতপ্রায় নদ- নদীগুলোর প্রাণ সঞ্চার হোক- ফয়সাল আহমেদ

এই দুই ব্রিক ফিল্ডের অন্যতম মালিক মোহাম্মদ রায়হান বললেন, ইউএনও ও এলাকাবাসী খালটি উদ্ধারের উদ্যোগ নিলে তাঁর আপত্তি থাকবে না।

একাধিক সূত্রমতে, খালটি ছিল ১৮-২০ ফুট চওড়া। আর দৈর্ঘ্য ৭ কিলোমিটার। হাটহাজারী সদর ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা শহীদুল ইসলাম গত ২৬ জুলাই ওই এলাকায় সরেজমিনে পরিমাপ করে দেখেন, খালটি শাহজালাল ব্রিক ফিল্ডের পশ্চিম অংশ থেকে চট্টগ্রাম-নাজিরহাট শাখা রেললাইন পর্যন্ত দুই কিলোমিটার ভরাট হয়ে গেছে। এর মধ্যে দেড় কিলোমিটার খালটি সমতল ভূমিতে পরিণত হয়েছে। এরপর থেকে আধা কিলোমিটার পর্যন্ত খালের কিছুটা নমুনা আছে। রেললাইনের পূর্ব দিক থেকে শেষ পর্যন্ত অর্থাৎ বাকি পাঁচ কিলোমিটার কিছু কিছু স্থানে পাড় কেটে নিলেও খালটি টিকে আছে। কিন্তু উৎসমুখ বন্ধ করে দেওয়ায় পানির প্রবাহ নেই বললেই চলে।

এই ভূমি কর্মকর্তার হিসাবে, দেড় কিলোমিটারে খালের মোট ভরাট করা জমির পরিমাণ ২২৭ শতক (২.২৭ একর)। স্থানীয় মানুষজন জানালেন, এর আগে মিঠাছড়া খালটির পাড় কেটে ইটভাটায় ব্যবহার করেছিল সোনালী-১ ও হোসাইন ব্রিকফিল্ড (ইটভাটা)। তবে এখন এই ভাটা দুটি বন্ধ আছে।

মিঠাছড়া উন্নয়ন কমিটির আহ্বায়ক এম ইকবাল বাহার জানালেন, তাঁরা একাধিকবার স্থানীয় সাংসদ বন ও পরিবেশমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদের কাছে চিঠি দিয়েছেন। মন্ত্রীর নির্দেশক্রমে উপজেলা প্রশাসন দখলের বিষয়টি জানতে তদন্ত কমিটিও করেছে। তদন্ত কমিটি দখলদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশও করেছে। কিন্তু আর কিছুই হয়নি।

পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপপরিচালক ফেরদৌস আনোয়ার প্রথম আলোকে জানান, শাহজালাল ব্রিক ফিল্ডের নবায়ন ফুরিয়েছে ২০১১ সালের ১৮ ডিসেম্বর। গত বছরের ২৩ মার্চ এই ইটভাটাকে দেড় লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এই জরিমানা আদায়ও হয়েছে। অপরদিকে সোনালী ব্রিক ফিল্ডের নবায়ন ফুরিয়েছে ২০০৭ সালের ৩ মে। এই ভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন বললেন, ‘আমরা ছেড়ে দেব না। অবশ্যই অবৈধ ইটভাটা মালিকদের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নেব।’

২৫ আগস্ট ২০১৮, প্রথম আলো।

সংশ্লিষ্ট বিষয়